এই সংঘাতে সবচেয়ে বেশি খুইয়েছে কে, ফায়দা লুটেছে কোন পক্ষ

SHARE

ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা থেকে বাঁচতে বাঙ্কারে আশ্রয় নেন ইসরায়েলি নাগরিকরা।

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),আন্তর্জাতিক   প্রতিনিধি,বুধবার   ২৫ জুন ২০২৫ ||  আষাঢ় ১১ ১৪৩২   :

মধ্যপ্রাচ্যের উত্তপ্ত মঞ্চে ইরান-ইসরায়েল সংঘাত আর নতুন কিছু নয়। তবে সর্বশেষ দফার সংঘাত শুধু এই দুই দেশের সীমান্তেই নয়, ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিবেশী কয়েকটি দেশ। আর সেই টানাপোড়েনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো।

Advertisement

মঙ্গলবার (২৪ জুন) যুদ্ধবিরতির ঘোষণার পরেও গোলাবর্ষণ, ড্রোন ও সাইবার হামলার অভিযোগ চলছে।  দুই পক্ষই একে অপরকে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত করছে। আর এরই ফাঁকে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা চূড়ান্ত কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন। এই সংঘাতে কে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত? আর এর ছত্রছায়ায় আদতে ফায়দা লুটেছে কারা?

বিশ্লেষকরা সবার আগে যে নামটি বলছেন, তা হলো ফিলিস্তিনি জনগণ। গাজা ও পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি হামলায় হাজারো বেসামরিক মানুষের মৃত্যু, লাখো মানুষের গৃহহীনতা, ধ্বংসস্তূপে পরিণত জনপদ-এটাই এই সংঘাতের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়।

অন্যদিকে, আঞ্চলিক শক্তি ইরানও এক অর্থে বড় ক্ষতির শিকার হয়েছে। দেশটির সামরিক স্থাপনা, ড্রোন ঘাঁটি, পারমাণবিক কর্মসূচির স্থাপনা লক্ষ্য করে ভয়াবহ হামলা; দেশের ভেতরেই বিস্ফোরণ, গুপ্তচরবৃত্তি, অভ্যন্তরীণ বিক্ষোভ উসকে তোলার প্রচেষ্টা — সব মিলে ইরানের অর্থনীতি ও অভ্যন্তরীণ স্থিতি চাপে পড়েছে।

ইসরায়েলের ক্ষেত্রেও ক্ষতি কম নয়। হাজারো রকেট হামলা, সীমান্ত অঞ্চলে অচলাবস্থা, বড় অঙ্কের সামরিক ব্যয় ও বৈশ্বিক জনমতের ক্ষতি- এগুলোই দেশটিকে চাপে রেখেছে। তবে সামগ্রিকভাবে বললে, মানবিক দিক থেকে সবচেয়ে বেশি মূল্য দিয়েছে গাজা ও লেবাননের সীমান্ত অঞ্চলের সাধারণ মানুষ।

Advertisement

 

কারা সবচেয়ে বেশি লাভবান: বিশ্লেষকদের বড় অংশ একমত, এই সংঘাতের সরাসরি সুবিধাভোগী মূলত আঞ্চলিক অস্ত্র ব্যবসায়ীরা এবং বৃহৎ সামরিক শিল্পের পৃষ্ঠপোষক দেশগুলো, বিশেষত দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া।

যুদ্ধবিরতির নামে মধ্যস্থতার কৃতিত্ব নিয়ে ট্রাম্প নিজের হারিয়ে যাওয়া ইমেজ ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছেন। ইসরায়েলের কাছে আরও নতুন অস্ত্র সহায়তা ও প্রযুক্তি বিক্রির সুযোগ পেয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে নিজের ‘অপরিহার্য’ অবস্থান আবারও জোরালোভাবে প্রমাণ করতে পেরেছে।

অন্যদিকে, ইরানের পাশে অবস্থান নিয়ে নিজেদের প্রভাব বলয়কে আরও পাকাপোক্ত করছে রাশিয়া ও চীন। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ভেঙ্গে বিকল্প বাজার ও সামরিক সহযোগিতা নিশ্চিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রকে এককভাবে ‘শান্তির রক্ষাকর্তা’ হিসেবে দাঁড়াতে দিচ্ছে না।

এ সংঘাতের মূল খেসারত দিয়েছে সাধারণ মানুষ- বিশেষত গাজা ও সীমান্ত অঞ্চলের নিরপরাধ নারী-শিশুরা। আর বৈশ্বিক কূটনৈতিক মঞ্চে লাভবান হয়েছে বড় শক্তিধর সামরিক ক্ষমতাধর দেশগুলো এবং তাদের অস্ত্র নির্মাতা করপোরেশনগুলো।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে- এই যুদ্ধবিরতি আর কতদিন টিকে থাকবে? এবং এ লড়াই শেষ পর্যন্ত কার কৌশলগত লাভ নিশ্চিত করবে? সময়ই সেই জবাব দেবে।

গাজা উপত্যকায় নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা মঙ্গলবার ৫৬ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। (২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতির আগ পর্যন্ত)। এতে আহত হয়েছেন এক লাখ ৩০ হাজারের বেশি বাসিন্দা। গৃহহীন প্রায় ১২ লাখ মানুষ। গাজায়  ৭৫ শতাংশ ভবনই ধ্বংসপ্রাপ্ত। গাজা সংঘাতে ইসরায়েলের নিহত হয়েছে আনুমানিক দেড় হাজার মানুষ। রকেট হামলা, হামাসের আক্রমণ, পাল্টা হামলায়

ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইসরায়েলের অবকাঠামো। দক্ষিণ সীমান্ত অঞ্চলে প্রচুর কৃষি খামার ও শিল্প এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত
হয়েছে। যুদ্ধ চলাকালে প্রায় ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে ইসরায়েলের।

আঞ্চলিক অস্ত্র বাণিজ্য: ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪-২৫ সালে ইসরায়েলের অস্ত্র আমদানি প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন অস্ত্র রপ্তানি গত এক বছরে ১৪ শতাংশ বেড়েছে।

গাজার স্কুলশিক্ষক থেকে আহমাদ সাইদ বলেন, ‘আমার স্কুল আর নেই। আমাদের পুরো পাড়াটাই ধুলোয় মিশে গেছে। যুদ্ধবিরতি বলছে, কিন্তু আমরা এখনও আতঙ্কে বেঁচে আছি।’

ইসরায়েলের সীমান্ত শহর আশকেলনের বাসিন্দা লিয়োর বার-জোহর বলেন, ‘রকেট হামলা বন্ধ হয়নি পুরোপুরি। আমরা চাই স্থায়ী শান্তি, শুধু বোমা আর ক্ষেপণাস্ত্র নয়।’

ইরানের বিশ্লেষক মাসুদ হাকিমি বলেন, ‘ইরান সামরিক ও কূটনৈতিকভাবে খরচ করেছে প্রচুর। কিন্তু আঞ্চলিক প্রভাব ধরে রাখতে এ ছাড়া উপায় ছিল না। সবচেয়ে বড় কথা, ইরানের ভেতরকার অর্থনৈতিক ক্ষতি এবার চোখে পড়ার মতো।’

মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশ্লেষক কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. লিনা খালিদ বলেন, ‘এই সংঘাত মূলত একটি দুঃসহ মানবিক ট্র্যাজেডি। বেনিফিশিয়ারি রাষ্ট্রগুলো সামরিক চুক্তি আর মধ্যস্থতার নামে রাজনৈতিক সুবিধা নিচ্ছে- আর বেসামরিক মানুষের দুঃখ বেচে আসল ফায়দা লুটছে অস্ত্র উৎপাদকরা।’

Advertisement

https://www.facebook.com/share/p/1NT3RTcPAN/

ওয়াশিংটনের থিঙ্কট্যাংক ‘মিডল ইস্ট পলিসি ইনিশিয়েটিভ’-এর গবেষক স্যাম পার্কার বলেন, ‘ট্রাম্প এই যুদ্ধবিরতিকে নিজের জয়ে রূপ দিতে চাইছেন। তবে ভেতরে ভেতরে মার্কিন প্রতিরক্ষা শিল্পের বিক্রি যে হারে বেড়েছে, সেটাই আসল ফায়দা।’