সাঈদীর রায়ের পর্যবেক্ষণ

SHARE

1319সাঈদীর রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর নির্মমতার সীমা নেই। সাঈদীর মতো দোসরদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় নির্মম ও জঘন্য অপরাধ চালিয়েছে তারা। তবে সাজা দেয়ার ক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড অথবা আদালত যেটা মনে করে সেটাই প্রয়োগ করা হয়েছে।

এ ক্ষেত্রে সাঈদীর অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী তাকে ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন করার মতো নয়। এ কারণে স্বাভাবিক মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত কারাদণ্ড দেওয়াই যুক্তিযুক্ত বলে মনে করছে আদালত।’

একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সাঈদীকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেয়া ফাঁসির দণ্ড পরিবর্তন করে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ।

২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ এ রায় দেন। ওইদিন আদালত সংক্ষিপ্ত রায় দেন। গতকাল বৃহস্পতিবার এর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়। সে সময়কার প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের (বর্তমানে অবসরে) নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ সাঈদীর মামলায় রায় ঘোষণা করেন। এ বেঞ্চের অপর সদস্যরা ছিলেন-বিচারপতি এস কে সিনহা(বর্তমান প্রধান বিচারপতি), বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী।

সাঈদীর  রায়ে বলা হয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে এই রায় দেয়া হয়। এই পাঁচ বিচারপতির মধ্যে বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী অবসরে গেছেন। এ পাঁচ বিচারপতির মধ্যে বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি এস কে সিনহা ও বিচাপরতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী একমত হয়ে রায় দেন।

তারা মৃত্যুদণ্ডের সাজা পরিবর্তন করে আমৃত্যুকারাদণ্ড দেন। এ তিনজনের মধ্যে মূল রায় লিখেছেন বিচারপতি এস কে সিনহা। তার সঙ্গে একমত হয়েছেন বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন ও বিচাপরতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। তাদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে এবং সাঈদীকে খালাস দিয়ে রায় দেন বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা। আর বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে রায় দেন।

মোট ৬শ’ ১৪ পৃষ্ঠার রায়ে বিচারপতি এস কে সিনহা লিখিছেন ১৫২ পৃষ্ঠা, বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা লিখেছেন ২শ’ ৪৪ পৃষ্ঠা এবং বিচারপতি বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী লিখেছেন ২শ’ ১৮ পৃষ্ঠা। এ তিনটি রায় সমন্বয় করে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়।

ট্রাইব্যুনালের রায়ে সাঈদীর বিরুদ্ধে আটটি অভিযোগ প্রমাণিত হলেও আপিল বিভাগে প্রমাণিত হয় ৫টি। ট্রাইব্যুনালে প্রমানিত তিনটি অভিযোগ থেকে আপিল বিভাগ সাঈদীকে খালাস দেন। আপিল বিভাগ প্রমানিত পাঁচটি অভিযোগের মধ্যে তিনটিতে আমৃত্যু কারাদণ্ড, একটিতে ১২ বছর ও একটিতে ১০ বছর কারাদণ্ড দেন।

বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহার লেখা মূল রায়ে বলা হয়েছে, আসামি পক্ষ অপরাধ সংগঠনের কথা অস্বীকার করেনি। এখানে আসামি পক্ষ এমন কিছু সাক্ষী উপস্থাপন করেছেন যা বিতর্কিত নয় এবং পারিপাশ্বিক সাক্ষ্য দ্বারা সমর্থিত হয়েছে। প্রসিকিউশন পক্ষ প্রমাণ করতে পেরেছে অন্য আসামিদের সঙ্গে এই আসামি সম্মিলিতভাবে সরাসরি অপরাধে অংশগ্রহণ করেছে।

রায়ে বলা হয়, মানবতাবিরোধী অপরাধের ৪০ বছর পর বিচার করা হচ্ছে। এরই মধ্যে রাজনৈতিক পরিবর্তন হয়েছে। দুটি সামরিক সরকার ক্ষমতায় এসে প্রশাসনিক ব্যবস্থার পরিবর্তন করেছে। নতুন রাজনৈতিক দল গঠিত হয়েছে।

ডানপন্থি জনগণ জামায়াতে ইসলামমির মত ধর্মভিত্তিক দলের মাধ্যমে দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর মতো লোকদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছে। ফলশ্রুতিতে জোট গঠন করে তারা ক্ষমতাসীন হয়েছে। এই রাজনৈতিক মেরুকরণ তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্থ করেছে।

রায়ে আরও বলা হয়, জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। সংবিদানের মূলনীতির পরিবর্তন করা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে রাজাকার ও শান্তি কমিটির তালিকা সংগ্রহ করা কঠিন। এটা বলা অতিরঞ্জিত হবে না যে, আসামি রাজাকারের নামের তালিকা থেকে নিজের নাম বাদ দিতে রাজনৈতিক প্রভাবকে কাজে লাগাননি।

রায়ে তদন্ত কর্মকর্তার গাফিলতির কথা উল্লেখ করে বলা হয়, ‘আমরা বেশ কয়েকটি অভিযোগের বিষয়ে  তদন্ত কর্মকর্তার গাফিলতি লক্ষ করেছি। তদন্ত কর্মকর্তা ইব্রাহিত কুট্টি হত্যার অভিযোগের বিষয়ে মমতাজ বেগমের করা এজাহার সংগ্রহে কার্যকর কোনো প্রচেষ্টা চালায়নি। একইভাবে প্রসিকিউটরও কোনো পদক্ষেপ নেননি। তিনি (প্রসিকিউটর) কোনো তদন্ত করেননি যে, মমতাজ বেগমের করা ওই এজাহার সত্য কিংবা মিথ্যা। তিনি এ বিষয়ে নিশ্চুপ থেকেছেন।

রায়ে বলা হয়, ‘এটা মনে রাখার দরকার যে, রাষ্ট্র মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের সামনে অপরাধীদের মুখোশ উম্মোচন ও সঠিক ইতিহাস লেখার জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছে। আমাদের অভিমত প্রসিকিউটর একজন শিক্ষানবীশ আইন কর্মকর্তার মত কাজ করেছেন। তারমধ্যে মামলা পরিচালনার যোগ্যতায় যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। তিনি এ মামলাকে উদাসীনতার সঙ্গে পরিচালনা করেছেন। দায়িত্বমীলতার সঙ্গে মামলা পরিচালনা করেননি তিনি।

চিফ প্রসিকিউটরও সে ক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা নেননি। তিনি (চিফ প্রসিকিউটর) যদি যথাযথভাবে তদারকি না করেন তবে তার এই অফিসে থাকার প্রয়োজন নেই। প্রসিকিউশন অফিস শহীদদের রক্তের সঙ্গে জুয়া খেলতে পারে না। এই মামলার মতো অন্য মামলাও তারা যেভাবে পরিচালনা করেছেন তাতে আমারা মর্মাহত।

এটা মনে রাখা দরকার যে এসব মামলার পরিচলানার সঙ্গে জড়িতরা অতিরিক্ত অর্থসহ অন্যান্য সুবিধা গ্রহণ করেছে। ভবিষ্যতে তাদের সরকারি কোনো দায়িত্ব দেয়া উচিত না।’

রায়ে বলা হয়, সরকার জনমতের দিকে তাকিয়ে এই বিচারের ঝুকি নিয়েছে। তাই বিচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ঝুকিভাতা দিয়েছে। প্রসিকিউটরদের দায়িত্ব ছিল যথাযথ আইনি সাক্ষ্য সংগ্রহ করা। এটায় তারা ব্যর্থ হয়েছে।

রায়ে তদন্ত সংস্থার ব্যর্থতার সম্পর্কে বলা হয়, তদন্ত র্সস্থা গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। অযোগ্য তদন্ত কর্মকর্তাকে কোনো মামলার সঙ্গে রাখা ঠিখ হবে না। তাকে এখনই সরানো উচিত। অন্যথায় যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো জঘন্যতম অপরাধের সঙ্গে জড়িতরা সুবিধা নেবে।

সাঈদীর শাস্তির বিষয়ে বলা হয়, ‘সকল আলোচনা পর্যালোচনা শেষে আমরা মনে করি, দেলওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ট্রাইব্যুনাল দোষী সাব্যস্ত করে ৭, ১০, ১৬, ১৯ ও ৮  (অংশ বিশেষ) নম্বর অভিযোগের ওপর যথাযথভাবে দোষী সাব্যস্ত করেছে। আমরা সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে ৭, ৮ (অংশ বিশেষ) ও ১০ নম্বর অভিযোগে শাস্তি দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করেছি।

আমরা ১৬ ও ১৯ নম্বর অভিযোগে শাস্তি বহাল রেখছি। ট্রাইব্যুনাল ৮ ও ১০ নম্বর অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। আমরা ৮ (আংশিক) নম্বর অভিযোগে মানিক পসারির ভাইয়ের ওপর নির্যাতন ও তাদের বাড়িতে লুটপাটের জন্য দোষী সাব্যস্ত করছি। ১০ নম্বর অভিযোগে শান্তি কমিটির সদস্য হিসেবে উমেদপুর গ্রামে হামলা, অগ্নি সংযোগ এবং বিশাবালী হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়ার জন্য দোষী সাব্যস্ত করছি।

এ অভিযোগে অন্য রাজাকাররা বিশাবালীকে হত্যা করে। আর সাঈদী ওই হত্যাকাণ্ডের সহযোগী ছিলেন। প্রধান আসামি ছিল অন্য রাজাকার। প্রসিকিউশন তাকে বিচারের আওতায় আনতে পারেনি। এমনকি তার নামও শনাক্ত করতে পারেননি।’

রায়ে বলা হয়, এটা সত্য যে, উভয় অপরাধ জঘন্য। কিন্তু মূল অপরাধীর অনুপস্থিতিতে সহযোগিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া যায় না। মৃত্যুদণ্ড দেয়ার ক্ষেত্রে দেখা হয় যে, অভিযুক্তকে যে জন্য সাজা দেয়া হচ্ছে তা নির্মম ও নারকীয় কী না। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ২০ (২) দারা অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী যেটা যৌক্তিক সেই শাস্তি দেবে।

রায়ে বলা হয়, ‘আমাদের মৃত্যুদণ্ড ছাড়া আদালত যেটা যৌক্তিক মনে করবে সে ধরণের সাজা দেওয়ার কোনো বিধি বিধান নেই। সাজা দেওয়ার নীতি তৈরি করা হয়নি। যুক্তরাজ্যে অপরাধের মাত্র অনুযায়ী আদালতকে শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা দিয়ে বিধি করা হয়েছে।

অপরাধের মাত্রা অপরাধ সংঘটনের প্রেক্ষাপট, অপরাধীর বয়স ও আচরণ ব্যক্তি বিশেষ ও সমাজ ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার মাত্রা, অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার সম্ভাব্য প্রভাব, অপরাধীর সংশোধনের বিষয় আমলে নিয়ে শাস্তি দেয়ার ক্ষেত্রে আদালত বিবেচনা করে। কিন্তু মানবতাবিরোধী অপরাধের ক্ষেত্রে এগুলো বিবেচ্য বিষয় নয়।

সাঈদী এমন এক অপরাধ করেছেন যখন মানুষ স্বাধিকার, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সংগ্রাম করছিল আর ওই সংগ্রামী মানুষের ওপর পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বর্বর হামলা করেছে। তখন সাঈদী তাদের সহায়তা করে অপরাধ করেছেন।

পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর নির্মমতার সীমা নেই। সাঈদীর মতো দোষরদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় নির্মম ও জঘন্য অপরাধ করেছে। তবে সাজা দেয়ার ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড অথবা আদালত যে টা মনে করে সেটাই প্রয়োগ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সাঈদীর অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী তাকে ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন করার মতো নয়। এ কারণে স্বাভাবিক মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত কারাদণ্ড দেয়াই যুক্তিযুক্ত বলে মনে করছে আদালত।’

বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার লেখা এই রায়ের সঙ্গে একমত পোষণ করে রায়ে স্বাক্ষর করেন তখনকার প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।

বেকসুর খালাস দিয়ে বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞার লেখা রায়ে বলা হয়েছে, আসামি পক্ষ প্রমাণ করতে পেরেছে, ১৯৭১ সালের মধ্য জুলাইয়ের পূর্ব পর্যন্ত দেরাওয়ার হোসেন সাঈদী যশোরের বাঘারপাড়া থানার দোহাখোলা গ্রামের রওশন আলীর বাড়িতে ছিলেন। তিনি মধ্য জুলাইয়ের পর পিরোজপুরের পাড়েরহাটে যান। অর্থাৎ সাক্ষ্য দ্বারা আসামি পক্ষ প্রমাণ করতে পেরেছে যে অপরাধ সংঘটনের সময় আসামি সাঈদী ঘটনাস্থলে ছিলেন না।

রায়ে বলেন, ‘আসামি ঘটনাস্থলে ছিলেন এটা আগে বিবেচ্য বিষয়। আসামি ঘটনাস্থলে ছিলেন এবং রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন এটা প্রমাণে রাষ্ট্রপক্ষ ব্যর্থ হয়েছেন। তাই আসামির করা আপিল মঞ্জুর করা হলো। রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল খারিজ করা হলো।