নির্বাচন ঘিরে নেতাদের আশ্রয়ে রাজনীতির মাঠে সক্রিয় চট্টগ্রামের সন্ত্রাসীরা

SHARE

বাঁ থেকে সন্ত্রাসী বড় সাজ্জাদ, ছোট সাজ্জাদ ও বাবলা। ছবি: সংগৃহীত

য়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (ভিডিও),চট্টগ্রাম  প্রতিনিধি, শনিবার   ০৮ নভেম্বর ২০২৫ ||  কার্তিক ২৪ ১৪৩২ :

চট্টগ্রাম-৮ আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী এরশাদ উল্লাহর গণসংযোগের সময় গুলিতে নিহত সরওয়ার হোসেন বাবলার সঙ্গে একাধিক দলের রাজনীতিকের ছবি সামাজিকমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এসব ছবি ছড়িয়ে পড়ার পর প্রশ্ন উঠছে, রাজনীতিবিদরা সন্ত্রাসীদের কাছে টানছে, নাকি সন্ত্রাসীরা রাজনীতিবিদদের?

Advertisement

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যাদের ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠছে সন্ত্রাসীদের।

গুলিতে নিহত বাবলা চাঁদাবাজি, অস্ত্র, হত্যাসহ ১৫ মামলার আসামি ছিলেন। নগর জামায়াতের সাবেক আমির শাহজাহান চৌধুরীসহ ফেসবুকে সরওয়ারের সঙ্গে বিএনপি নেতা আসলাম চৌধুরী, চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহ, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান, জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক শাকিলা ফারজানার ছবি দেখা গেছে তার সঙ্গে।

হত্যা, চাঁদাবাজি, অস্ত্রসহ ১৭ মামলার আরেক আসামি সাজ্জাদ হোসেন ওরফে ছোট সাজ্জাদ। তার সঙ্গে বিএনপির নেতা মীর হেলাল উদ্দিনের ছবি রয়েছে। আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী ইসমাইল হোসেন টেম্পু ৩৪ মামলা এবং শহীদুল ইসলাম বুইশ্যা ১৮ মামলার আসামি। তাদের সঙ্গে ছবি আছে বিএনপি নেতা আবু সুফিয়ানের। আগে আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের সঙ্গে দেখা যেত সিআরবি জোড়া খুনসহ ১৫ মামলার আসামি হেলাল আকবর চৌধুরী বাবরকে। হত্যা, চাঁদাবাজিসহ ১৭ মামলার আসামি আলী আকবর ওরফে ছেঁড়া আকবরকে দেখা যেত আওয়ামী লীগের সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের সঙ্গে।

২০২৪ সালের ২৭ জুলাই গ্রেপ্তার হয়েছিলেন গুলিতে নিহত সারোয়ার বাবলা। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর জামিনে বেরিয়ে নিজেকে যুবদল নেতা পরিচয় দিতে থাকেন। বিএনপি নেতাদের সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক অনুষ্ঠানের ছবি-ভিডিও ফেসবুকে শেয়ার করতেন বাবলা। তবে নগর যুবদল এ বিষয়ে ওই সময় বিবৃতি দিয়ে জানায়, বাবলা যুবদলের কেউ না।

কারাগারে থাকা অবস্থায় বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আসলাম চৌধুরীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে বাবলার। কারাগার থেকে বেরিয়ে নিজেকে আসলাম চৌধুরীর অনুসারী যুবদল নেতা হিসেবে পরিচয় দিতেন তিনি বলে জানান বিএনপির নেতাকর্মীরা।

Advertisement

প্রতিটি উপজেলায় সংবাদদাতা আবশ্যক। যোগাযোগ ০১৭১৪৪৯৭৮৮৫

 

সর্বশেষ গত ১৯ সেপ্টেম্বর বিদেশে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদ আলী খানের ডান হাত বাবলার বিয়েতে অংশ নেন আসলাম চৌধুরী, চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহ, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান ও জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য সোলায়মান আলম শেঠ। তবে তার মৃত্যুর পর সরওয়ার বিএনপির কেউ ছিল না বলে দাবি করেছেন বিএনপি নেতারা।

এ বিষয়ে আসলাম চৌধুরী বলেন, একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে আমরা অনেকের বিয়েতে যাই। তার মানে এই নয়, সে আমার অনুসারী। শীর্ষ সন্ত্রাসী যেই হোক, তাকে আইনের আওতায় আনা হোক।

কারাগারে দেখা হওয়ার পর বাবলা ভালো হতে চেয়েছিল জানিয়ে আসলাম চৌধুরী আরও বলেন, কারাগারে সরওয়ারের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। আমাকে জানিয়েছিল, সে ভালো হতে চায়। স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চায়। খারাপ পথ থেকে কেউ যদি ভালো হতে চায়, তাকে স্বাগত জানানো উচিত। কিন্তু এটিই তার কাল হয়েছে বলে মনে করি আমি।

সরওয়ারের সঙ্গে ছবির ব্যাপারে নগর জামায়াতের সাবেক আমির শাহজাহান চৌধুরীর কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। গতকাল রাতে তার একান্ত সহকারী মো. আইয়ুব বলেন, ‘স্যার (শাহজাহান চৌধুরী) নির্বাচনী গণসংযোগে ব্যস্ত। আমি তার সঙ্গে নেই।’ শাহজাহান চৌধুরী চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসনে জামায়াত মনোনীত প্রার্থী।

হত্যাকাণ্ডের পেছনে বিএনপি নেতা মীর হেলালের হাত থাকতে পারে বলে অভিযোগ বাবলার ছোট ভাই আজিজ হোসেনের। তিনি বলেন, কারাগারে ভাইয়ের সঙ্গে আসলাম চৌধুরীর পরিচয় হয়। এরপর জামিনে বেরিয়ে তার রাজনীতি করতেন আমার ভাই। এটা মানতে পারতেন না মীর হেলাল। তার কথা, এখানে তিনি কেন আসলাম চৌধুরীর রাজনীতি করবেন?

আজিজ হোসেনের দাবি, সন্ত্রাসী সাজ্জাদের সঙ্গে মীর হেলালের যোগাযোগ রয়েছে। তারাই আমার ভাইকে মেরে ফেলেছে। গতকাল শুক্রবার (৭ নভেম্বর) সরওয়ারের বাবা আব্দুল কাদেরের দায়ের করা মামলায় সাজ্জাদকে আসামি করা হয়েছে।

অভিযোগ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার মীর মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, কোনো শীর্ষ সন্ত্রাসী আমার অনুসারী হতে পারে না। আমার নাম ব্যবহার করে কেউ যদি অপকর্ম করে, তাকে গ্রেপ্তার করার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। কোনো সন্ত্রাসীর জন্য আমি কখনোই কোথাও তদবির করিনি।

গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে নগরের চান্দগাঁও এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে একাধিকবার গোলাগুলিতে লিপ্ত ছিল নগরের অন্য দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী ইসমাইল হোসেন টেম্পু ৩৪ মামলা এবং শহীদুল ইসলাম বুইশ্যা ১৮ মামলার আসামি। এই দুই সন্ত্রাসী নিজেকে দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক আবু সুফিয়ানের অনুসারী হিসেবে পরিচয় দেন। সন্ত্রাসী টেম্পুর সঙ্গে আবু সুফিয়ানের বেশ কিছু ছবি সামাজিক মাধ্যমে দেখা যায়।

নগরের চান্দগাঁও ও পাঁচলাইশ এলাকায় কর্মরত চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, টেম্পু ও বুইশ্যা উভয়ই বিএনপি নেতা আবু সুফিয়ানের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।

তবে বিএনপি নেতা আবু সুফিয়ান বলেন, আমরা রাজনীতি করি। গণমানুষের সঙ্গে মিশতে হয় আমাদের। এই সময় অনেকে আমাদের সঙ্গে ছবি তোলে। কিন্তু কোনো সন্ত্রাসীকে আমি কখনোই আমার অনুসারী মনে করি না। এদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাই।

পুলিশ সূত্র জানায়, গত বৃহস্পতিবার নগরের চালিতাতলী এলাকায় টেম্পুর ভাই ইদ্রিস আলীকে গুলি করে বুইশ্যা ও তার অনুসারীরা। এ ঘটনায় একজনকে গ্রেপ্তারও করেছে র‍্যাব। টেম্পুর আরেক ভাই নুরুন্নবী সোহাগ, আবদুর রহিম, মো. আনিস, সাইফুল, মো. সোহেল, মো. তৌহিদ, জাহেদ হোসেন মুন্না, মো. রবিউল, মো. ইলিয়াস কাঞ্চন, মো. শরীফ, মো. ইশতিয়াকসহ অর্ধশতাধিক উঠতি সন্ত্রাসী রয়েছে টেম্পুর বাহিনীতে।

অপর গ্রুপের শহীদুল ইসলাম ওরফে বুইশ্যা নগরের ষোলশহর বদিউল আলম গলির মো. আলীর ছেলে। তার বাহিনীর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, জমি দখল, ছিনতাইসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। গত ২১ জুলাই নগরের বহদ্দারহাট এলাকায় একটি ফ্ল্যাটে তার গোপন টর্চার সেলের হদিস পায় পুলিশ। সেখানে অভিযান চালিয়ে পুলিশের লুট করা গুলি ও বিপুল সংখ্যক দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়।

জানতে চাইলে চান্দগাঁও থানার ওসি জাহিদুল কবির বলেন, সন্ত্রাসী টেম্পু ও বুইশ্যাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। কিন্তু বারবার স্থান পরিবর্তন করায় গ্রেপ্তার করতে দেরি হচ্ছে।

শুধু বিএনপি কিংবা জামায়াত নেতা নন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুজন নেতার সঙ্গে সরওয়ারের ছবি দেখা গেছে। বর্তমান রাজনীতিতে তাদের শক্ত অবস্থান থাকায় এদের সঙ্গেও যোগাযোগ রেখেছে তারা। গত বছরের ডিসেম্বরে কক্সবাজারে একটি অনুষ্ঠানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া নেতাদের সঙ্গে সন্ত্রাসী বাবলার ছবি রয়েছে। এর মধ্যে একটি ছবিতে পাশাপাশি দুটি চেয়ারে হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিতে দেখা গেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক নেতা রাসেল আহমেদ ও সরওয়ার বাবলাকে। আরেকটি ছবিতে দাঁড়ানো অবস্থায় তাঁকে দেখা গেছে সাবেক কেন্দ্রীয় সহ-সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফির সঙ্গে।

সরওয়ার বাবলা নামে কাউকে আমি চিনি না। এই নামে কোনো সন্ত্রাসী আছে, সেটাও আমার জানা নেই—এমনটি জানিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কেন্দ্রীয় সহসমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফি বলেন, কোনো অনুষ্ঠানে গেলে ছবি তোলার জন্য অনেকে অনুরোধ করে। এটি তেমন কোনো ছবি হতে পারে।

নাগরিক পার্টির উত্তরাঞ্চলের সংগঠক ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক রাসেল আহমেদকে ফোন করা হলে তা রিসিভ করা হয়নি।

Advertisement

যেসব সন্ত্রাসী আগে আওয়ামী লীগের ছায়া খুঁজত, এখন তারা বিএনপি, জামায়াতের ছায়া খুঁজছে—এমন মন্তব্য করে সুশাসনের জন্য নাগরিক-চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী বলেন, নির্বাচন এলে সন্ত্রাসীদের কদর বাড়ে। আধিপত্য ধরে রাখতে রাজনীতিবিদরা তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেন। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা এসব কাজে হতাশ হয়। সাধারণ মানুষও বিরক্ত হয়। তার পরও এই সংস্কৃতি থেকে বের হচ্ছে না কেউ।

সূত্র: দৈনিক সমকাল