সবই স্বীকার করলেন রেলমন্ত্রী

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),ঈশ্বরদী (পাবনা) প্রতিনিধি, সোমবার, ০৯ মে ২০২২ : মন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয়ে বিনা টিকিটে ৩ যাত্রীর ট্রেন ভ্রমণ। জরিমানা আদায়ের জেরে বরখাস্ত ট্রাভেলিং টিকিট এক্সামিনার (টিটিই) শফিকুল ইসলাম। সবই হয়েছে মন্ত্রীর স্ত্রী’র নির্দেশে। এনিয়ে সারা দেশে তোলপাড়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় বইছে। অনেকে রেলমন্ত্রী ও তার স্ত্রীকে নিয়ে ট্রল করে পোস্ট দিচ্ছেন। গত শনিবারও রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন বিনা টিকিটে ট্রেন ভ্রমণকারী সেই ৩ যাত্রীকে আত্মীয় হিসেবে অস্বীকার করেছেন। টিটিই বরখাস্তের পেছনে তার স্ত্রীর সম্পৃক্ততা গণমাধ্যমে প্রকাশ পেলে সরাসরি ইউটার্ন নিলেন রেলমন্ত্রী। পাল্টিয়েছেন সুর। নানা নাটকীয়তার পর অবশেষে বিনা টিকিটে ভ্রমণকারী সেই যাত্রীদের আত্মীয় হিসেবে স্বীকার করেছেন

স্ত্রীর এসব কাণ্ডে বিব্রত ও লজ্জিত বলে স্বীকার করেছেন রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন। সেইসঙ্গে আলোচিত টিটিই শফিকুল ইসলামের বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
গতকাল দুপুরে রেলভবনে সংবাদ সম্মেলনে এসে টিটিই শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে স্ত্রীর অভিযোগ ও বিনা টিকিটে ট্রেনে চড়া ওই তিন যাত্রীর আত্মীয়তা স্বীকার করেন রেলমন্ত্রী।

মন্ত্রী বলেন, আমার বিয়ে হয়েছে মাত্র ৯ মাস হলো। নতুন যে স্ত্রীকে আমি গ্রহণ করেছি, সে ঢাকাতেই থাকে। তার মামাবাড়ি ও নানাবাড়ি হলো পাবনা। আমি শুনেছি তারা (বিনা টিকিটে ভ্রমণকারী) আমার আত্মীয়। এটা এখন ঠিক, যেটা আমিও এখন শুনেছি। এর আগে পর্যন্ত আমি জানতাম না বিনা টিকিটে ভ্রমণকারী ওই তিন যাত্রী কারা। আমার জানার কথাও না।

তিন যাত্রীকে জরিমানা করায় টিটিই বরখাস্ত হওয়ার ঘটনায় মন্ত্রীর স্ত্রী শাম্মী আকতার মনির নির্দেশনা ছিল বলে সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। এ প্রসঙ্গে রেলমন্ত্রী বলেন, আমিও বিষয়টি শুনেছি। ভুলভ্রান্তি হলে মানুষ তো সেভাবেই দেখবে। এখানে যদি দেখা যায় আমার স্ত্রী কোনো দোষ করে থাকে… ভুল করে থাকে…। কিন্তু এখানে আমার কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। বলা হচ্ছে যে মন্ত্রীর কারণে এমনটা ঘটছে। আমার যদি কিছু করার থাকতো তাহলে তো সরাসরিই করতে পারতাম। কারও সাহায্যের তো দরকার হবে না। যেটা বলা হচ্ছে বা টার্গেট করা হচ্ছে, মন্ত্রী এই কারণে এটা ঠিক না। তবে মেসেজটা যেভাবে গেছে এটা সঠিক হয়নি।
এক প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রী বলেন, ওই তিন যাত্রী যে তার স্ত্রীর আত্মীয়, সেটা তিনি শনিবার সংবাদ সম্মেলনের সময়ও পর্যন্ত জানতেন না। স্ত্রীর অভিযোগের কারণেই টিটিই শফিকুলকে বরখাস্ত করা হয়েছিল কিনা তিনি তা জানেন না। তবে সেটাই যদি কারণ হয়ে থাকে, তাহলে তদন্তে সবকিছু বেরিয়ে আসবে।

বিনা টিকিটে ৩ যাত্রীকে আত্মীয় পরিচয় দিয়ে রেলমন্ত্রী বলেন, যে প্রক্রিয়ায় টিটিইকে বহিষ্কার করা হয়েছে সেটা যথাযথ ছিল না। তাই টিটিই শফিকুল ইসলামের সাময়িক বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। একইসঙ্গে বহিষ্কার আদেশ দেয়া সংশ্লিষ্ট রেল কর্মকর্তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হবে।
এরআগে গত বৃহস্পতিবার রাতে রেলমন্ত্রীর স্ত্রী শাম্মী আক্তার মনি ডিসিও নাসির উদ্দিনকে ফোন করে আত্মীয়দের ব্যাপারে জানান। পরে নাসির উদ্দিন টিটিই শফিকুল ইসলামকে বরখাস্ত করেন। রেলমন্ত্রী বলেন, আমার স্ত্রীর ফোন পাওয়ার পর নাসির উদ্দিন কোন আইনে বা কোন ক্ষমতাবলে টিটিইকে বরখাস্ত করা হয়েছে, তা জানতে চাওয়া হবে।

সুজন বলেন, টিটিইর কাজ হলো রেলে শৃঙ্খলা আনা। তার কাজই তো রেলে যাত্রীদের সহযোগিতা করা, তাকে সাহায্য করা, সঠিক জায়গায় সেবা দেয়া। রেলের লোকদের দায়িত্বই সেটা। টিটিই শফিকুল ইসলাম সেদিন তার দায়িত্বই সঠিকভাবে পালন করেছেন। এজন্য শফিকুল ইসলামকে পদোন্নতি বা অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দেয়া হতে পারে। তাকে পুরস্কৃত করার কথাও ভাববে রেলপথ মন্ত্রণালয়। তবে ঘটনাটি যেভাবে ঘটছে এজন্য আমি বিব্রত এবং লজ্জিত হয়েছি। সংশ্লিষ্ট ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কমিটির মাধ্যমে পুরো ঘটনা বের হয়ে আসবে।

টিটিই শফিকুলের বিষয়ে শাম্মী আকতার মনির টেলিফোনে অভিযোগ দেয়ার বিষয়টি স্বীকার করে রেলমন্ত্রী বলেন, আমার স্ত্রী অভিযোগ দিয়েছে যে, এদের (বিনা টিকিটে ট্রেনে চড়া তিন আত্মীয়) সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা হয়নি। স্ত্রীর সেই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতেই টিটিই শফিকুলকে বরখাস্ত করা হয়েছে কিনা তা জানার জন্যই ডিসিওকে শোকজ করেছি। এখনো ডিসিওর বক্তব্য আমরা পাইনি।
এদিকে এ ঘটনায় রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের সাময়িক পদত্যাগের দাবি জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি), যাত্রী কল্যাণ সমিতিসহ বিভিন্ন সংগঠন। সংশ্লিষ্ট টিকিট পরিদর্শককে (টিটিই) সাময়িক বরখাস্ত করাকে ন্যক্কারজনক দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে রেলমন্ত্রী বলেন, টিআইবি কে? টিআইবিটা হঠাৎ আসলো কোত্থেকে? আমার পদত্যাগ চাওয়ার আগে টিআইবির আরও সময় নেয়া উচিত ছিল। তারা তা না করে দ্রুত সময়ে একটি বিবৃতি দিয়েছে। এখানে মন্ত্রীর কোনো সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা তা দেখার আগেই তারা এটা করেছে।

কোন ভুলের কারণে বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে জানতে চাইলে রেলমন্ত্রী বলেন, উইথড্রো করছি এজন্য যে আপনারা প্রশ্ন তুলেছেন যে একজন যাত্রী ঢাকা আসছে, সে একটা অভিযোগ দিলো, অভিযোগটা এত অল্প সময়ের মধ্যে লিখিত অভিযোগটা সে কীভাবে পেলো।

মন্ত্রীর স্ত্রী পাকশীর ডিসিওকে ফোন করে থাকলে সেখানে কোনো অনিয়ম হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমার স্ত্রী তো শুধু ‘অভিযোগই দিয়েছেন’। আমি ১৩ বছর এমপি। আমার রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গে সে (শাম্মী) পরিচিত নয়। আমার ওয়াইফের যদি কোনো অভিযোগ থাকে রেলের বিষয়ে, তাহলে তার উচিত ছিল আমার সঙ্গে আগে কথা বলা। এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু এটা সে করেনি। এই জায়গায় কিছুটা ব্যত্যয় হয়েছে বলে আমার ধারণা। এ কারণে আমি মনে করি যে, সাসপেনশন অর্ডারটা (টিটিইর বরখাস্তের আদেশ), এটা সঠিক হয়নি। এটা প্রত্যাহার করার জন্য ইতিমধ্যে আমরা বলেছি।

এদিকে মন্ত্রীর স্ত্রীর মামাতো বোন ইয়াসমিন আক্তার নিপা গণমাধ্যমকে জানান, রেলমন্ত্রীর স্ত্রী শাম্মী আকতার মনি তার ফুপাতো বোন। সে হিসেবে প্রান্ত রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনের ভাগনে। আর গত বৃহস্পতিবার প্রান্তর সঙ্গে রেলযাত্রায় অংশ নেন মন্ত্রীর ছোট মামাশ্বশুর জাহাঙ্গীর আলমের দুই ছেলে হাসান ও ওমর। ঈশ্বরদীর নুর মহল্লার কর্মকারপাড়ায় জাহাঙ্গীর আলমের বাড়িতে গত শুক্রবার বিকাল পর্যন্ত ছিলেন রেলমন্ত্রীর স্ত্রী শাম্মী আকতার। পাবনায় এলে তিনি এই বাড়িতে ওঠেন। ওই বাড়ির আরেকটি অংশে থাকে প্রান্তর পরিবার। প্রান্তসহ তিনজনের ট্রেনে চড়ার আগে মন্ত্রীর স্ত্রী ট্রেনের লোকজনকে বিষয়টি অবহিত করেছিলেন। নিপা বলেন, মন্ত্রী মহোদয়ের ওয়াইফ গার্ডকে ফোন দিয়ে বলছে, আমার বাচ্চারা গেল, ঠিকঠাকভাবে নামায়ে দিয়েন। এখন তো কেবিন খালি যাচ্ছিল। তাই উনি (গার্ড) কেবিনে নিয়ে ওদের বসায় দিছে, যে রেলের রিলেটিভ, একটু আরামেই যাক। গার্ড মন্ত্রীর স্ত্রীর পরিচিত ছিলেন। ওই কারণে গার্ড তাদেরকে (তিনযাত্রী) কেবিনে বসায় দিছে। ওই মুহূর্তে টিটিই গিয়ে বলছে, রেলের রিলেটিভ হও আর যাই হও, বাপের তো গাড়ি না। উল্টাপাল্টা কথা বলেছে। তখন আমার ছেলে আমাকে ফোন দিছে। আমি তখন ঘুমাচ্ছিলাম, আর উনি (রেলমন্ত্রীর স্ত্রী) পাশেই ঘুমাচ্ছিল। আমি তখন উনাকে বললাম, শাম্মী তাড়াতাড়ি দেখো তো। তখন উনি ফোন করে রাগ হয়ে গেছেন।

এর আগে শুক্রবার রাতে পাবনার ঈশ্বরদী স্টেশন থেকে ঢাকাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনে চড়েন রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর ভাগ্নে পরিচয় দেয়া তিন যাত্রী। তারা হলেন, মন্ত্রীর স্ত্রীর বোনের ছেলে ইমরুল কায়েস প্রান্ত ও তার চাচাতো ভাই ওমর ও হাসান। ওই সময় টিটিই শফিকুল ইসলাম তাদের কাছে টিকিট দেখতে চাইলে তারা রেলমন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয় দেন। টিটিই বিষয়টি পাকশী বিভাগীয় রেলের সহকারী বাণিজ্যিক কর্মকর্তা (এসিও) নুরুল আলমের সঙ্গে আলাপ করলে তিনি সর্বনিম্ন ভাড়া নিয়ে টিকিট কাটার পরামর্শ দেন। এসিওর পরামর্শ অনুযায়ী টিটিই ওই তিন ট্রেন যাত্রীকে এসি টিকিটের পরিবর্তে সবমিলিয়ে এক হাজার ৫০ টাকা জরিমানাসহ সুলভ শ্রেণির নন এসি কোচে সাধারণ আসনের টিকিট দেন। এরপরই ট্রেন ঢাকায় পৌঁছার আগেই মধ্যপথে ভোররাতে টিটিইকে সাময়িক বরখাস্ত করে মোবাইল ফোনে জানিয়ে দেয়া হয়। এ ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। ঘটনার ব্যাখ্যা জানতে গতকাল বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তার (ডিসিও) কার্যালয়ে তলব করা হয় শফিকুল ইসলামকে। রেলের পাকশী বিভাগীয় সহকারী পরিবহন কর্মকর্তা সাজেদুল ইসলামকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটিও গঠন করা হয়েছে। গতকাল টিটিই শফিকুল ইসলামকে বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করে নিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। একইসঙ্গে শফিকুলকে তড়িঘড়ি বরখাস্তের আদেশ দেয়া বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা (পাকশীর ডিসিও) নাসির উদ্দিনকে নোটিশ দিয়ে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে।

এদিকে আমাদের ঈশ্বরদী (পাবনা) প্রতিনিধি জানান, গতকাল অভিযোগকারী ইমরুল কায়েস প্রান্ত, টিটিই শফিকুল ইসলামসহ প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজনের কাছ থেকে গত বৃহস্পতিবার ঘটে যাওয়া ঘটনার মৌখিক ও লিখিত বক্তব্য শুনেন তদন্ত কমিটি। পাকশী বিভাগীয় রেলের কার্যালয়ে তাদের বক্তব্য রেকর্ড করা হয়। বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করায় খুশি হয়েছেন শফিকুল ইসলাম। তদন্ত কমিটির প্রধান বিভাগীয় সহকারী পরিবহন অধিকর্তা সাজেদুল ইসলাম বাবু বলেছেন, আমরা অভিযোগকারী এবং অভিযুক্তের বক্তব্য গ্রহণ করেছি। প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য জানারও চেষ্টা করা হচ্ছে। অসদাচরণের ঘটনা ঘটেছে কিনা সেটি নিশ্চিত হতে সকল বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।