
ছবি: সবার দেশ এর সৌজন্যে
ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (ভিডিও),সবার দেশ এর সৌজন্যে, শুক্রবার ৩১ অক্টোবর ২০২৫ || কার্তিক ১৫ ১৪৩২ :
বাংলার ইতিহাসে সময়ের পর পর এক অদৃশ্য চক্র ঘুরে ফিরে আসে—অন্যায়, লুটপাট, দমন-পীড়ন আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে জনতার জেগে ওঠার চক্র। এ চক্রের প্রতিটি বাঁকে শাসকশ্রেণি নির্মাণ করেছে তাদের সুবিধার সাম্রাজ্য, আর তার বিপরীতে দাঁড়িয়েছে মানুষের শিকড়-নির্ভর এক আবেগময় প্রতিবাদ—যেখানে ছিলো শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, শিক্ষক, পেশাজীবী, মুক্তচিন্তার মানুষ, আর সর্বোপরি দেশের প্রতি এক অগাধ ভালোবাসা।

১৯৪৭ থেকে ২০২৪—এ একটিই ধারাবাহিকতা
ক্ষমতাসীনদের বেপরোয়া লুটপাট ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে মানুষের জেগে ওঠা। প্রতিবারই এ জাগরণ এসেছে নিচু তলার মানুষদের ভেতর থেকে; কোনও রাজপ্রাসাদ থেকে নয়, বরং গাঁয়ের হাট, চায়ের দোকান, কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির বেঞ্চ থেকে। পলাশী থেকে শুরু করে যুগে যুগে সাক্ষী- প্রাসাদ থেকে তো শুধু ষড়যন্ত্রই হয়েছে, আর বটতলা থেকে এসেছে মুক্তির বারতা।

Advertisement

১৯৪৭: মুক্তি, কিন্তু অসম মুক্তি
১৯৪৭ সাল, ভারত উপমহাদেশের বিভাজন—‘স্বাধীনতা’র নামে এক রক্তাক্ত সমাপ্তি এবং এক অসম শুরু। পূর্ব বাংলার মানুষ ভেবেছিলো পাকিস্তান মানেই মুক্তি, ইসলামি ভ্রাতৃত্বের নামে সমান অধিকার। কিন্তু পরের দুই দশকেই প্রমাণিত হয়, পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকশ্রেণি এ ভূমিকে কেবল কাঁচামালের খনি, শ্রমের উৎস, আর ভোগের বাজার হিসেবে ব্যবহার করবে। রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে, অর্থনৈতিক বৈষম্যে, প্রশাসনিক বঞ্চনায় জন্ম নেয় নতুন বোধ—‘আমরা বাঙালি, এবং আমাদের মুক্তি অন্যদের শাসনে নয়।’

১৯৫২: ভাষার জন্য বুকের রক্ত
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি কেবল ভাষার লড়াই নয়; এটি ছিলো সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার ঘোষণা। রাষ্ট্রের দমননীতির বিরুদ্ধে প্রথম সংগঠিত জনঅভ্যুত্থান। পাকিস্তানি রাষ্ট্রযন্ত্র তখনও ভাবেনি যে সাধারণ ছাত্র, শ্রমিক, শিক্ষক—এ ‘নিম্ন’ শ্রেণিরাই রাষ্ট্রের ভিত কাঁপিয়ে দিতে পারে। কিন্তু ইতিহাস এখানেই তার নিয়ম দেখিয়েছে—যখন শাসক শ্রেণি অন্ধ হয়, তখন ইতিহাসের চোখ খোলে নিচু তলার মানুষদের ভেতর।

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’—এ গানটি একদিকে যেমন শোকের, অন্যদিকে তা এক ঘোষণাপত্র। বাঙালির আত্মপরিচয় তখন নতুন করে জন্ম নেয়।
১৯৬৯: আগুনে আন্দোলন ও স্বৈরাচারের পতন
ষাটের দশকের শেষভাগে পাকিস্তানের তথাকথিত উন্নয়নের মুখোশ ছিঁড়ে পড়ে। আইয়ুব খানের তথাকথিত ‘ডেভেলপমেন্ট’ প্রকল্পে পূর্ব বাংলার মানুষের প্রাপ্তি ছিলো ক্ষুধা, বৈষম্য ও অপমান। এ বৈষম্যের বিরুদ্ধে ১৯৬৯ সালে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত সৃষ্টি করে। রাজপথে পতন ঘটে আইয়ুব খানের একনায়কতন্ত্রের।

এই সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা ছিলো—
ইতিহাসে নেতৃত্ব জন্ম নেয় না ক্ষমতার ভেতর থেকে, জন্ম নেয় প্রতিবাদের ভেতর থেকে।
১৯৭১: সশস্ত্র মুক্তির মহাকাব্য
৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ হলো সে ধারাবাহিক প্রতিবাদের পরিণতি। ভাষা, অর্থনীতি, অধিকার—সব কিছুর চূড়ান্ত রূপ নেয় স্বাধীনতার দাবিতে। রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ জন্ম নেয়; কিন্তু সে জন্মের শপথ ছিলো—শোষণহীন, বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা। দুঃখজনকভাবে, সে শপথ আজও অসম্পূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, যা ছিলো গণমানুষের জন্য, পরে বন্দী হয়েছে রাজনৈতিক এলিটদের স্বার্থে। শাসকের মুখ বদলেছে, কিন্তু আচরণ বদলায়নি।

Advertisement
প্রতিটি উপজেলায় সংবাদদাতা আবশ্যক। যোগাযোগ ০১৭১৪৪৯৭৮৮৫

১৯৯০: এক স্বৈরাচারের পতন ও গণতন্ত্রের স্বপ্ন
এরপরের বড় বাঁক আসে ১৯৯০ সালে। এরশাদের দীর্ঘ সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার আন্দোলন আবারও প্রমাণ করে—বাংলার মানুষ অত্যাচার সহ্য করে, কিন্তু অন্যায়ের কাছে মাথা নত করে না।
গণআন্দোলনে পতন ঘটে এরশাদ শাসনের। কিন্তু এর পরের গণতন্ত্রও ধীরে ধীরে পুঁজিবাদী গোষ্ঠীর বন্দী হয়ে পড়ে। ভোট হয়, কিন্তু ভোটের মালিক জনগণ নয়; গণতন্ত্র থাকে, কিন্তু তা কেবল কাগজে।
২০২৪: ছত্রিশ দিনে স্বৈরাচার পতন
২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব—এটি একবিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে অভাবনীয় ঘটনা। মাত্র ৩৬ দিনের মধ্যে টিএসসি থেকে শুরু হওয়া শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন রূপ নেয় এক সর্বজনীন ফ্যাসিবাদবিরোধী বিপ্লবে।

চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিলো, তা পরিণত হয় রাষ্ট্রীয় দমননীতির বিরুদ্ধে সারাদেশের বিদ্রোহে। সোশ্যাল মিডিয়ায়, নাগরিক সমাজ, এমনকি প্রশাসনের ভেতরকার সৎ কর্মকর্তারাও যুক্ত হন এ গণআন্দোলনে। ফলাফল—১৬ বছরের স্বৈরাচারী সরকারের পতন, এবং গণমানুষের আত্মবিশ্বাসের পুনর্জন্ম।
এ ঘটনার গভীর তাৎপর্য হলো—
যে কোনও যুগেই পরিবর্তনের সূচনা হয় ক্ষুদ্র পরিসর থেকে, কিন্তু তার প্রভাব বিস্তার করে মহাকাব্যের মতো।
‘মেঘনার গাঙ গুরুণ্ডি ২০২৫’: নতুন ভাবনার সূচনা
এ প্রেক্ষাপটে ‘মেঘনার গাঙ গুরুণ্ডি ২০২৫’ কেবল একটি বিনোদনমূলক প্রোগ্রাম নয়; এটি এক নতুন ভাবনার বীজরোপণ।
মেঘনার তীরে, বৈদ্যের বাজার থেকে শুরু হওয়া এ উদ্যোগে যুক্ত হয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা, বিজ্ঞানী, অধ্যাপক, সাংবাদিক, লেখক, আইনজীবী, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংকার ও ব্যবসায়ীসহ নানা পেশার মানুষ। তাদের উদ্দেশ্য একটাই—দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনৈতিক কাঠামো নতুনভাবে চিন্তা করা। যেমন এক সময় টিএসসির চায়ের দোকানে কয়েকজন তরুণ আলোচনা করেছিলেন— ‘চাকুরিতে ন্যায্য সুযোগ’ নিয়ে, তেমনি আজ মেঘনার তীরে আলোচনা হচ্ছে—
কীভাবে রাষ্ট্রকে ফের জনগণের রাষ্ট্রে পরিণত করা যায়।

মেঘনার দিনটি: ঐক্যের প্রতীক
বৈদ্যের বাজার থেকে সকাল সাড়ে সাতটায় ট্রলারযাত্রা শুরু হয়। চালিভাঙা, রামপুর বাজার, হরিপুর, মামুদপুর, ওমাকান্দা, শেখের গাঁও, আলীপুর, ব্রাহ্মণচর, কাশিপুর, তালতলী হয়ে তারা পৌঁছান মায়া দ্বীপে। সেখানে হরেক রকম স্থানীয় খাবার, স্থানীয় সঙ্গীত, শৈশবের স্মৃতি আর তীব্র রাজনৈতিক আলাপ মিলে তৈরি হয় এক সাংস্কৃতিক ঐক্যবোধ।
আয়োজনটি মূলত এক ধরণের ‘চিন্তার উৎসব’
‘ওয়েলকাম ড্রিংস’ হিসেবে কচি ডাবের পানি দিয়ে আপ্যায়ন শুরু হওয়া খাবারের টেবিলে যেমন ছিলো ইলিশ ভাজা, পুঁটি মাছ ভাজা, শুঁটকি ভর্তা, চিংড়ি উস্তা, মাছ লাউ, পুইশাকে নোনা ইলিশ, পাবদা মাছের ঝোল, মাসকলাইয়ের ডাল; তেমনি আলাপের টেবিলে ছিলো—রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ, শিক্ষার মান, নৈতিকতার সংকট, এবং মুক্তচিন্তার পথ। প্রবীণরা শোনাচ্ছিলেন ৭১-এর স্মৃতি, তরুণরা বলছিলেন ২০২৪-এর বিপ্লবের গল্প। দুই প্রজন্মের এ সংলাপই হয়তো ভবিষ্যতের নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রেরণা হয়ে উঠবে।
ঐতিহাসিক এ ‘গাঙ গুরুণ্ডিতে’ অংশগ্রহন করেন ড. মোহাম্মদ নুরুজ্জামান (সিইও, ড্যাফোডিল গ্রুপ), সিদ্দিকুর রহমান ভূইয়া (সাবেক ফিন্যান্স ডিরেক্টর, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়), স্কোয়াড্রন লীডার মোঃ গোলাম কিবরিয়া আব্বাসী (অবঃ, সচিব, জেলা সশস্ত্র বাহিনী বোর্ড, দিনাজপুর), ড. মফিজুল ইসলাম, অধ্যক্ষ রেজাউল করিম, অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন, নুরুল আমিন (অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা), রোটারিয়ান মো. জহিরুল ইসলাম (এফসিজিএ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, জপুর হোমস্ লিঃ), সাঈদ আহমেদ খান (স্পেশাল রিপোর্টার, দৈনিক ইনকিলাব) আবু ইউসুফ (নির্বাহী সম্পাদক, সবার দেশ), বীর মুক্তিযোদ্ধা আ স ম শিবলী রেজা (অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার),আবদুল আলীম (অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার),এমা. আবদুস সাত্তার, ইঞ্জিনিয়ার এমএমএ শাহজাহান, অ্যাডভোকেট আবির সোহেল, আবদুল হালিম (ডেপুটি রেজিস্ট্রার, শহীদুল্লাহ্ হল, ঢাবি), প্রিন্সিপাল আবদুল হালিম, আমজাদ হোসেন, মিহিনউল্লাহ মাস্টার, নাজিমউদ্দিন মাস্টার, মিডিয়াকর্মী জাকির হোসেন, ব্যবসায়ী নজরুল ইসলামসহসহ আরও অনেকে।

ইতিহাসের শিক্ষা: বদল আনে মানুষ, দল নয়
বাংলার ইতিহাস আমাদের একটিই শিক্ষা দেয়—
ইতিহাস কখনও নিজে বদলায় না; মানুষই তাকে বদলায়। আর সে মানুষ সাধারণ, অখ্যাত, গরিব, কিন্তু নৈতিকভাবে অদম্য।
১৯৪৭-এ তারা মুক্তি চেয়েছিলো, ৫২-এ তারা ভাষা রক্ষা করেছিলো, ৬৯-এ তারা স্বৈরাচার ভেঙেছিলো, ৭১-এ তারা স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছিলো, ৯০-এ তারা আবার জেগে উঠেছিলো, আর ২০২৪-এ তারা প্রমাণ করেছে—প্রযুক্তির যুগেও মানুষই ইতিহাসের মূল চালিকা শক্তি।
Advertisement
আগামী দিনের বাংলাদেশ: নতুন সামাজিক চুক্তির আহ্বান
‘মেঘনার গাঙ গুরুণ্ডি ২০২৫’-এর আলোচনায় যেমন উঠে এসেছে, আগামী বাংলাদেশে প্রয়োজন এক নতুন সামাজিক চুক্তি—
- যেখানে শিক্ষা, ন্যায়বিচার, ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের বণ্টন হবে ন্যায্য ও অংশীদারিত্বমূলক।
- রাজনীতি হবে প্রতিযোগিতা নয়, সহযোগিতার ক্ষেত্র।
- বিকাশ হবে কেবল GDP নয়, নাগরিক মর্যাদা ও নৈতিক উন্নয়নে।
এ দেশের মানুষ দেখেছে—
ক্ষমতার প্রাসাদ যত উঁচুই হোক না কেন, মেঘনার ঢেউ তা ধুয়ে দিতে জানে।
শেষকথা: আশাবাদের জয়
‘মেঘনার গাঙ গুরুণ্ডি ২০২৫’ আমাদের মনে করিয়ে দেয়—
- যখন মানুষ আশা হারায়, তখন ইতিহাস থেমে যায়।
- কিন্তু যখন তারা আবার বিশ্বাস করতে শেখে—তখন পাহাড়ও কেঁপে ওঠে।
২০২৪ সালের মতো পরিবর্তন একদিনে আসে না; আসে ধীরে ধীরে, মানুষের অন্তর থেকে। আজ মেঘনার গাঙে যে আলোচনা শুরু হলো, তা হয়তো কাল হবে এক নতুন ইতিহাসের ভূমিকা।
হয়তো শত বছর পর কেউ লিখবে—
বাংলাদেশের নবজাগরণের সূচনা হয়েছিলো মেঘনার গাঙ থেকে।
আমরাও বলতে পারবো গর্ব করে—
আমরা আশাবাদি ছিলাম, তাই জয়ীও হয়েছিলাম।


