নিজেদের মেরুদণ্ড ক্ষয় করে দেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত রাখা কৃষকের সঙ্গে প্রতারণা তো বটেই, তাদের নাম ভাঙিয়েও অর্থ লুটে নিচ্ছেন কৃষি কর্মকর্তারা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকারি প্রণোদনার আওতায় বীজ, সার ও কীটনাশক বিতরণে শুভঙ্করের ফাঁকির প্রমাণ পেয়েছে চ্যানেল 24। অনুসন্ধানে সরকারি প্রকল্পের টাকা ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে লোপাটের তথ্যও মিলেছে। কৃষকদের অভিযোগ, বর্তমানে কৃষিখাতের বড় দুর্যোগের নাম অসাধু কৃষি কর্মকর্তা।
Advertisement
গত সেপ্টেম্বর মাসে দুই বিঘা জমিতে পেঁয়াজ চাষের আশায় বীজতলা প্রস্তুত করেছিলেন মেহেরপুরের বুড়িপোতা ইউনিয়নের ইছাখালী গ্রামের প্রান্তিক কৃষক রবিউল ইসলাম।
তিনি বলেন, আবাদ করব কীভাবে? সরকার আমাদের ক্ষতির মুখে ঠেলে দিয়েছে।
এ সময়ে ক্ষেতজুড়ে সবুজের পরশ থাকার কথা থাকলেও সব পরিশ্রম, ঘাম এবং অর্থ মিশে গেছে শূন্যতায়। সরকারের দেয়া বীজ থেকে পেঁয়াজের বদলে গজিয়েছে ঘাস। উপজেলা কৃষি অফিস থেকে পাওয়া মাত্র এক কেজি বীজের জন্য জমি প্রস্তুত করতে তার খরচ হয়েছে ৬৫ হাজার টাকা।
Advertisement
প্রতিটি উপজেলায় সংবাদদাতা আবশ্যক। যোগাযোগ ০১৭১৪৪৯৭৮৮৫
রবিউল আরও জানান, এই বীজ দেয়ার পর একটি চারা পর্যন্ত ওঠেনি। পরে বাধ্য হয়ে বাজার থেকে বীজ কিনেছি। আমি গরিব মানুষ, এক বিঘা জমি চাষ করতেই ৭০ হাজার টাকা খরচ হয়। ভালো বীজ আমি কোথায় পাব?
শুধু মেহেরপুর নয় যশোর, মাগুরা ও ঝিনাইদহ জেলাতেও একই অভিযোগ পেয়েছে অনুসন্ধান দল। কৃষকদের দাবি, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে নিম্নমানের বীজ সরবরাহ করা হয়েছে।
একজন কৃষক বলেন, আমরা মাঠে পড়ে থাকি। কৃষক না বাঁচলে দেশ বাঁচবে কীভাবে? আরেকজন বলেন, বাংলাদেশে কৃষকের তো কোনো মূল্যই নেই।
কিন্তু কৃষকের এই ক্ষতির পেছনে রয়েছে আরও বড় দুর্নীতির চিত্র।
গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ আবাদের জন্য চলতি অর্থবছরে ২০ জেলার ৫০ হাজার কৃষকের জন্য ১৭ কোটি টাকার প্রণোদনা বরাদ্দ দেয় সরকার। কাগজে–কলমে কৃষক প্রতি ৩ হাজার ৩০০ টাকার প্রণোদনা–প্যাকেজে থাকার কথা ছিল ২ হাজার ২০০ টাকার এক কেজি পেঁয়াজ বীজ, ৩৮০ টাকার ২০ কেজি ডিএপি সার, ৩৬০ টাকার ২০ কেজি এমওপি সার এবং ৩৫৫ টাকার এক কেজি বালাইনাশক।
কিন্তু বাস্তবে এসব উপকরণ ঠিকভাবে মেলেনি কৃষকের হাতে।
এক কৃষকের ভাষ্য, এখন পর্যন্ত আমরা পাইনি। সরকারি অনুদান এলেও নিম্নশ্রেণির কৃষকের কাছে তা পৌঁছায় না।
বীজের মান পরীক্ষা করা হয় খুলনা আঞ্চলিক বীজ পরীক্ষাগারে। তারা মানহীনতার কথা আংশিক স্বীকার করলেও দায় চাপালেন বিতরণকারী কৃষি কর্মকর্তাদের ওপর।
তাদের একজন জানান, আমরা অধিকাংশ বীজই ভালো পেয়েছি। বাকিটা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তারা বলতে পারবেন।
তবে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়েছে মাগুরা জেলায়। এখানকার বীজ প্রত্যয়ন কর্মকর্তা সরাসরি দায় স্বীকার করেছেন।
মাগুরা জেলা বীজ প্রত্যয়ন কর্মকর্তা ড. সুশান্ত কুমার তরফদার বলেন, কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হলে দেশের ক্ষতি। যাদের দায়িত্ব ছিল তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।
কিন্তু মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা স্বীকার করলেও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের খুলনা অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক কোনো অনিয়মের তথ্য অস্বীকার করেছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক রফিকুল ইসলাম বলেন, এমন অভিযোগ আমাদের কাছে আসেনি। শুধু বীজ পৌঁছাতে দেরির কথা এসেছে।
এদিকে, ভুল বিল-ভাউচারের মাধ্যমে অর্থ লোপাটের প্রমাণও মিলেছে।
মেহেরপুর সদর উপজেলার বারাদি গ্রামে বীজতলার ছাউনি তৈরির জন্য স্থানীয় আলম মোল্লার কাছ থেকে ৮ হাজার ৪শ টাকার বাঁশ কেনার হিসাব দেখানো হয়েছে। কিন্তু তার পরিবার জানায়, আলম মোল্লা ২০০০ সালেই মারা গেছেন। তারপরও তার নামে ২০২৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর বিল উত্তোলন করা হয়েছে।
মেহেরপুর শহরের ‘ভাই ভাই স্টোর’ নামের দোকান থেকে ২৩ হাজার টাকার নেট ও পলিনেট কেনা দেখানো হলেও দোকানটি মূলত কসমেটিকস বিক্রি করে।
Advertisement
এর আগে বীজ ক্রয় ও বিতরণের দায়িত্বে ছিল বিএডিসি। কিন্তু অনিয়মের অভিযোগে কয়েকজন কর্মকর্তার চাকরি যাওয়ার পর দায়িত্ব হস্তান্তর হয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কাছে।