(ভিডিও) ‘আমি মরি নাই, আমারে শহীদ বানাইয়া দিছে’ এনসিপি নেতার মামলা বাণিজ্য

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),ঢাকার কেরানীগঞ্জ  প্রতিনিধি,শনিবার   ০৯ আগস্ট ২০২৫ ||  শ্রাবণ ২৫ ১৪৩২ :

ঢাকার কেরানীগঞ্জে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত জিহাদ নামের ১১ বছরের এক শিক্ষার্থীকে মৃত দেখিয়ে মামলাবাণিজ্য করার অভিযোগ উঠেছে ঢাকা জেলা এনসিপি’র সহ-সমন্বয়ক মো. শাহজাহান সম্রাট ও তার সঙ্গীদের বিরুদ্ধে। ‘নিহত’ জিহাদের বাবা কিছুদিন আগে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন যে, জিহাদ মরেনি। জিহাদের বাবা জহিরুল ইসলাম রাজু বলেছেন, শাহজাহান সম্রাট তাকে ৩০ লাখ টাকা ও ৪ কাঠা জায়গা দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে এ মামলা করিয়েছে; সম্রাট নিজেই মামলার কাগজপত্রের ব্যবস্থা করেছেন। এ ঘটনা কেরানীগঞ্জে চাঞ্চল্যের জন্ম দিয়েছে।

দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত বছরের ৬ অক্টোবর জহিরুল ইসলাম রাজু নামের এক ব্যক্তি ঢাকার আদালতে তার ছেলেকে হত্যার বিষয়ে একটি কোর্ট-মামলা (কমপ্লেইন রেজিস্ট্রার বা সিআর) দায়ের করেন। পরে আদালতের নির্দেশক্রমে ৮ অক্টোবর কেরানীগঞ্জ মডেল থানা ১০৯/৩০২/১১৪/৩৪ ধারায় ১১৮ জনকে আসামি করে মামলা রুজু করে। আদালত কেরানীগঞ্জ মডেল থানার ওসিকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বলে।

Advertisement

মামলার বিবরণীতে জহিরুল ইসলাম রাজু বলেন, ‘আমি কেরানীগঞ্জ মডেল থানার ওয়াশপুরের বাসিন্দা। গত বছরের ৫ আগস্ট দুপুর দেড়টায় আমার ১১ বছর বয়সী ছেলে জিহাদ কেরানীগঞ্জের ঘাটার চর-বসিলা ব্রিজ রোডে কোটা আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়। কয়েকটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েও জিহাদ সুস্থ না হলে ডাক্তাররা জানান, জিহাদের আর কোনো চিকিৎসা নেই। তারা জিহাদকে বাড়ি চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন। মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর জিহাদ মারা যায়।’

জিহাদের বাবার দায়ের করা মামলায় কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে কেরানীগঞ্জ মডেল থানার পুলিশ।

অনুসন্ধানকালে কেরানীগঞ্জে কোটা আন্দোলনে আহত ও নিহতদের ব্যাপারে কথা হয় সেই সময়ে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ছাত্রদের সঙ্গে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেরানীগঞ্জ মডেল থানা কমিটির সদ্য সাবেক আহ্বায়ক সাফায়েত হোসেন ঢালী দেশ রূপান্তরকে জানান, কোটা আন্দোলনে কেরানীগঞ্জে কেউ গুরুতর আহত বা নিহত হয়নি। ৫ আগস্ট ঘাটার চরে এমন কোনো গোলাগুলির ঘটনা বা কারও নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। জিহাদ নামের কেউ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেনি কিংবা মারা যায়নি। দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে এ কথাও জানা গেছে, জিহাদ হত্যা মামলায় একটি পক্ষ স্থানীয় অনেক ব্যবসায়ীকে আসামি হিসেবে নাম দিয়ে দেওয়া হবে এমন ভয় দেখিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এই ব্যবসায়ীরা নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না, দলটির কোনো কমিটিতে থাকার প্রমাণও পাওয়া যায়নি। তবে মোটা অঙ্কের টাকা দিলেও ভয়ে মিডিয়ার সামনে কথা বলতে রাজি হননি ওই ব্যবসায়ীদের কেউ।

এদিকে দেশ রূপান্তরের হাতে আরেকটি নথি আসে, যেটিতে দেখা যায় কয়েক মাস আগে শহীদ হওয়া জিহাদ আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য দিয়েছে। সে যে মারা যায়নি, এ কথা সে বলেছে। জিহাদের বাবা রাজুও আদালতে ১৬৪ ধারায় বয়ান দিয়ে বলেছেন, ‘জিহাদ হত্যা মামলাটি মিথ্যা ছিল। সম্রাট ও তার সহযোগীরা তাকে ৩০ লাখ টাকা ও ৪ কাঠা জমি দেওয়ার লোভ দেখালে তিনি লোভে পড়ে মামলাটি করেন। এখন তিনি মামলাটি উঠিয়ে নিতে চান।’

জহিরুল ইসলাম রাজুর বয়ানের সত্যতা যাচাই করার জন্য দেশ রূপান্তর থেকে এই দুই প্রতিবেদক মামলার কাগজে ব্যবহৃত ঠিকানাগুলোতে গিয়ে দেখতে পান, সমস্ত ঠিকানাই ভুয়া। পরে একটি হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরের সূত্র ধরে গাজীপুরের দুর্গম একটি এলাকায় প্রথমে শহীদ ও পরে জীবিত উদ্ধার হওয়া জিহাদ তার বাবা জহিরুল ইসলাম রাজু এবং তাদের পুরো পরিবারের খোঁজ পান।

জিহাদ ও তার পরিবার প্রথমে পুরো বিষয়টি অস্বীকার করে, পরে প্রতিবেদকদের সঙ্গে থাকা নথিপত্র দেখে অকপটে স্বীকার করে নেয় সব কিছু। প্রথমেই প্রতিবেদকদের কথা হয় মৃত দেখিয়ে মামলা করা জিহাদের সঙ্গে। জিহাদ দেশ রূপান্তরকে বলে, ‘আমি জীবিত আছি, মারা যাইনি। গত বছরের কোটা আন্দোলনের সময় আমরা সাভারে ভাড়া বাসায় থাকতাম। ৫ আগস্টে আমি গুলি খাই ঠিকই, তবে সেটা কেরানীগঞ্জে নয়, সাভারে। ৫ আগস্ট পুলিশের ছোড়া একটি বুলেট আমার পায়ে এসে লাগে। কিছুদিন চিকিৎসা নেওয়ার পর সুস্থ হয়ে বাসায় যাই। তবে কেরানীগঞ্জ এলাকাটির নাম যে বলছেন, সেখানে আমি যাইনি। আমি চিনি না সে এলাকা।’

জিহাদের বাবা দেশ রূপান্তরকে জানান, ‘সম্রাট নামের কেরানীগঞ্জের এক লোক আমাকে লোভ দেখিয়ে মামলাটি করতে বলেন। পরে জানতে পারি, সম্রাট ও তার সহযোগীরা মামলাটিকে ঘিরে বাণিজ্য করছেন। এরপর আমি আদালতে গিয়ে সমস্ত বিষয় খুলে বলি। আমার ছেলে আহত হওয়ার পরে সাভারের কিছু লোকের মাধ্যমে সম্রাটের সঙ্গে পরিচয় হয়। সম্রাট প্রথমে বলেন, জিহাদ গুলি খেয়েছে এ ঘটনায় মামলা করলে আমি আপনাকে ৩০ লাখ টাকা ও কেরানীগঞ্জে ৪ কাঠা জমি দেব। এ কথা শুনে প্রথমে আমি রাজি হয়েছিলাম। আমি এত পড়ালেখা জানি না, সম্রাট আমাকে নিয়ে গিয়ে কাগজপত্রে সই করতে বললে আমি সই করি।’

তিনি বলেন, ‘পরে সম্রাট আমার ছেলে হত্যার ব্যাপারে একটা মিথ্যা মামলা দায়ের করেন। এ কথা শুনে আমি প্রতিবাদ করলে সম্রাট আমাকে বিভিন্নভাবে ভয় দেখান। এ ঘটনার সময় ছেলে জিহাদ ও পরিবার নিয়ে সাভারে থাকতাম। মামলার কয়েক মাস পরে সম্রাট জানান, দ্রুত সাভার থেকে আমাদের চলে যেতে হবে এবং মামলার বিষয়ে কাউকে জানানো যাবে না। জানালে জিহাদের বড় ক্ষতি হতে পারে, এই ভয়ে আমরা গাজীপুরে চলে আসি। পরে যখন জানতে পারি, সম্রাট মামলার কথা বলে কেরানীগঞ্জের অনেকের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিচ্ছেন তখন আদালতে গিয়ে মামলাটি মিথ্যা স্বীকার করে জবানবন্দি দিই আমরা।’

মামলার বাদী সম্রাটের পূর্ণ পরিচয় হিসেবে জানা যায়, সম্রাট এখন এনসিপির ঢাকা জেলার সহ-সমন্বয়কের দায়িত্বে আছেন।

এরপর দেশ রূপান্তর থেকে সম্রাটের বিষয়ে অনুসন্ধান করে জানা যায়, সম্রাটের পুরো নাম মোহাম্মদ শাহজাহান সম্রাট, তিনি বর্তমানে এনসিপির সঙ্গে জড়িত থাকলেও, ২০২১ সাল পর্যন্ত কেরানীগঞ্জ মডেল থানা যুবদলের সঙ্গে জড়িত থেকে বিএনপির রাজনীতি করতেন। গত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হন তিনি, যদিও কেরানীগঞ্জের বাস্তা ইউনিয়নে মেম্বার পদে হেরে যান। গত বছরের ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত কোটা আন্দোলনে তেমনভাবে জড়িত না থাকলেও ৫ তারিখে শেখ হাসিনার পতনের পরে বিজয় মিছিলে অংশগ্রহণ করে এনসিপির বড় নেতা বনে যান। এ সংক্রান্ত তথ্যপ্রমাণও দেশ রূপান্তরের হাতে আছে।

মামলার বিষয়ে সম্রাটের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হলে দেশ রূপান্তরকে তিনি বলেন, ‘নাউজুবিল্লাহ! এগুলো সব মিথ্যা কথা, আমি জড়িত নই।’ এ কথা বলেই ফোন কেটে দিয়ে সাক্ষাতে দেখা করতে বলেন।

Advertisement

কেরানীগঞ্জ মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মনিরুল হক ডাবলু মামলার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ‘এমন একটা মামলা হয়েছিল শুনেছি। পরে মামলার বাদী ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়ে বলেছেন, এটি মিথ্যা মামলা। আমরা সেটি কোর্টে পাঠিয়ে দিয়েছি।’ মামলাটি এখন কোর্টের ‘মামলা মনিটরিং সেল’-এ রয়েছে বলে জানান তিনি।

বাপ ও মায়ের সাথ্বে বামে জিহাদ (মৃত) মামলায়