মিয়ানমারে বন্দি ১৪ বাংলাদেশি জেলে, ভিক্ষা করে চলছে মুবিনার সংসার!

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম,(ভিডি),কক্সবাজার প্রতিনিধি ,সোমবার, ০৮ এপ্রিল ২০২৪, ২৫ চৈত্র ১৪৩০ : কক্সবাজারের টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপের জালিয়াপাড়া। নাফনদী সংলগ্ন বেড়িবাঁধ এলাকার বাইরে অবস্থিত গ্রামটিতে অনেকটা নদীর কুলের সঙ্গে জোয়ার-ভাটা মিশে যায়। সেই গ্রামের দুই সন্তানের জননী মুবিনা খাতুন। যার স্বামী আলী আকবর নাফ নদী আর সাগরে মাছ ধরেই জীবিকা নির্বাহ করতেন। গত দুই বছর ধরে আলী আকবর মিয়ানমারের কারাগারে বন্দি। ফলে দুই সন্তান নিয়ে এখন ভিক্ষা করে মুবিনার।

Advertisement

সম্প্রতি শাহপরীর দ্বীপের জালিয়াপাড়ায় জরাজীর্ণ বাড়িতেই বসে সময় সংবাদের সঙ্গে কথা হয় মুবিনা খাতুনের।

তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী প্রায় ২ বছর ১ মাস মিয়ানমারের কারাগারে বন্দি। তাই এখন দুই সন্তান নিয়ে সংসার চালাতে খুবই কষ্ট হচ্ছে। বাজারে, স্টেশনে গিয়ে ভিক্ষা করি। ভিক্ষা করার টাকা দিয়ে কোনো রকম অনাহারে-অর্ধাহারে বেঁচে আছি। শুধু অপেক্ষায় আছি, কখন স্বামী মিয়ানমারের কারাগার থেকে দেশে ফিরে আসবে।

কিন্তু তার স্বামী আলী আকবর কখন ফিরতে পারবেন, সেটাই তিনি জানেন না।

শুধু মুবিনা খাতুনই নন, টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপের জালিয়াপাড়া এলাকাটিই একটি জেলে পল্লী। যে পল্লীর ১৪ জেলেই এখন মিয়ানমারের কারাগারে। যাদের পরিবার রয়েছে চরম উৎকণ্ঠায়। কারও স্বামী বা কারও সন্তান দীর্ঘ ২ বছরের বেশি সময় ধরে বন্দি মিয়ানমারের কারাগারে।
 

দুই বছর হলো স্বামী মিয়ানমারের কারাগারে বন্দি। সন্তান নিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করেই সংসার চালাতে হচ্ছে মুবিনাকে। ছবি: সময় সংবাদ

তাদের দাবি, মিয়ানমারের কারাগারে তাদের সাজা শেষ হয়েছে। এখন তাদেরকে স্বদেশে ফেরাতে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছে এসব জেলে পরিবার।

Advertisement

ঘটনার সূত্রপাত ২০২২ সালের ১৫ মার্চ। ওইদিন নাফনদীতে মাছ শিকারকালে বাংলাদেশের ১৮ জেলেকে ধরে নিয়ে যায় মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী- বিজিপি। পরে ১৮ জেলের মধ্যে অপ্রাপ্তবয়স্ক ৪ জনকে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে ৪ মাস পর বিজিবির কাছে হস্তান্তর করে মিয়ানমার। কিন্তু বাকি ১৪ জেলে এখনও মিয়ানমারের কারাগারে বন্দি।

অপ্রাপ্তবয়স্ক ৪ জনের একজন জালিয়াপাড়ারই রেজাউল করিম। ২০২২ সালের ১৫ মার্চ রেজাউলের বয়স ছিল ১৬ বছর। ওইদিন নাফনদীতে ৪টি নৌকায় মাছ শিকারে যাওয়া ১৮ জেলের মধ্যে সেও ছিল একজন।

কী হয়েছিল সেইদিন? এমন প্রশ্নের উত্তরে রেজাউল করিম বলে, ‘আমরা ৪টি ট্রলারে নাফনদীতে বাংলাদেশের জলসীমায় মাছ শিকার করছিলাম। হঠাৎ দেখি নদীতে কতগুলো কাঠ ভেসে যাচ্ছে। তখন মাছ শিকার না করে কাঠগুলো ধরছিলাম। কিন্তু হুট করে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর একটি স্পিডবোট এসে অস্ত্রের মুখে আমিসহ বাংলাদেশি ১৮ জেলেকে ধরে তাদের বিওপিতে নিয়ে যায়। প্রায় ১ ঘণ্টা আটকে রাখার পর মিয়ানমার বাহিনী ১ কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। কিন্তু টাকা নেই বলাতে তারা আমাদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। প্রায় ১ মাস ৯ দিন পর্যন্ত বিভিন্ন সময় আদালতে নিয়ে যেত। তারপর কারাগারে পাঠাত।’

সে আরও বলে, ‘একদিন আমাদের ৪ জনকে আলাদা করে বাকি ১৪ জনকে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আমাদের বুচিদংয়ের একটি জায়গায় নিয়ে যায়। ওখানে প্রায় ১৭-১৮ দিন রাখে। তারপর একদিন আবার আদালতে তুললে আমাদের বয়স কম হওয়াতে ছেড়ে দেয়ার জন্য বলা হয়। পরে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে আমাদের ৪ জনকে বিজিবির কাছে হস্তান্তর করে। আর বাকি ১৪ জন জেলেকে সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়।’

এ সময় কথা হয় মিয়ানমারের কারাগারে থাকা দুই ভাই মোহাম্মদ হোসেন ও ইসমাঈলের মা আয়েশা খাতুনের সঙ্গেও।

তিনি বলেন, ‘আমার দুই সন্তানকে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী নাফ নদী থেকে ধরে নিয়ে গেছে প্রায় ২ বছর হয়ে গেছে। যেভাবে হোক আমার দুই ছেলে মিয়ানমার থেকে ফিরিয়ে আনলে খুবই খুশি হব। এই দুই ছেলে ছাড়া আমার আর কেউ নেই।’

রেদুয়ান বেগম নামের অপর এক নারী বলেন, ‘আমার ছেলে ও মেয়ের জামাইসহ সবার নাকি কারাভোগের মেয়াদ শেষ হয়েছে। এখন বাংলাদেশ সরকারের কাছে আকুল আবেদন, আমাদের সন্তানদের মিয়ানমার থেকে ফেরত আনা হোক।’
 

মিয়ানমারের কারাগারে বন্দি ১৪ বাংলাদেশি জেলে পরিবারে অভাব-অনটন জেঁকে বসেছে। ছবি: সময় সংবাদ

শাহপরীর দ্বীপের জালিয়াপাড়া ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি আব্দুল গনি বলেন, ‘ধরে নিয়ে যাওয়া ১৪ জেলে সবাই বাংলাদেশের বাসিন্দা। এসব জেলেকে ফেরত পেতে প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করেছে জেলে পরিবারগুলো।’

বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কোনো কর্মকর্তা কথা বলতে রাজি হননি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিষয়টি পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মীমাংসা হওয়ার বিষয়। তবে সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ জানিয়েছেন, বাংলাদেশে প্রবেশ করে আশ্রয় নেয়া মিয়ানমারের ১৮০ সীমান্তরক্ষী ও সেনাসদস্যকে ফেরত পাঠানোর পাশাপাশি মিয়ানমারে আটকা পড়া ১৭০ জন বাংলাদেশিকে দেশে আনার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এরা সবাই মিয়ানমারের কারাগারে বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করছেন। ওখানে এই ১৪ জেলেও আছেন কিনা তা দেখতে হবে।

Advertisement

মিয়ানমারের চলমান সংঘাতের জের ধরে সেখান থেকে ১৭৭ জন বিজিপি ও ৩ সেনা সদস্য বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। এদের সবাইকে নাইক্ষ্যংছড়ির বিজিবি স্কুল ভবনে রাখা হয়েছে।

এর আগে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন বিজিপিসহ ৩৩০ জন। যার মধ্যে ৩০২ জন বিজিপি সদস্য, ৪ জন বিজিপি পরিবারের সদস্য, ২ জন সেনা সদস্য, ১৮ জন ইমিগ্রেশন সদস্য ও ৪ জন বেসামরিক নাগরিক ছিলেন। এদের ১৫ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়।