মানসিক ভারসাম্যহীন রুমার ঠিকানা যখন পরিত্যাক্ত অ্যাম্বুলেন্স!

SHARE

 

শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভবনের পেছনের পরিত্যক্ত অ্যাম্বুলেন্সে বসবাস প্রতিবন্ধী নারী রুমার। ছবি:ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি)

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),শেরপুরের ঝিনাইগাতী প্রতিনিধি ,শনিবার, ১৩ জানুয়ারি ২০২৪ : মানসিক ভারসাম্যহীন রুমা (৩৫)। কথা বলেন না; শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। কিছু জিজ্ঞেস করলে, আদালত ছাড়া কিছুই বলতে পারেন না তিনি।

Advertisement

রুমা কখনো গাছ তলায়, কখনো রাস্তায়, আবার কখনও পরিত্যক্ত ভবনের নিচে, আর বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলেই শীতের তীব্রতা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে অবস্থান নেন শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভবনের পেছনের পরিত্যক্ত অ্যাম্বুলেন্সে। এই অ্যাম্বুলেন্সেই রাত কাটাচ্ছেন মানসিক ভারসাম্যহীন ওই নারী।


স্থানীয়রা জানান, গেল বছরের শেষের দিকে হাসপাতাল চত্বরের পরিত্যক্ত একটি অ্যাম্বুলেন্সে রাত্রিযাপন শুরু করেন মানসিক ভারসাম্যহীন এই নারী। তীব্র শীতের মধ্যেও সারাদিন পুরনো কাপড় পরে এদিক-সেদিক ঘোরাফেরা করেন। তার হাঁটাচলা অন্য সাধারণ মানুষের থেকে আলাদা। তিনি হাঁটেন খুব দ্রুত। তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলে তিনি রেগে যান। আর বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলেই চলে যান তার গন্তব্য হাসপাতাল চত্বরের পেছনে থাকা পরিত্যক্ত অ্যাম্বুলেন্সটিতে। পরে হাসপাতালের সামনে নির্দিষ্ট একটি চায়ের দোকানে প্রতিদিন চা-বিস্কুট আর দুবেলা ভাত খান সেখানে। সম্প্রতি স্থানীয় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষ থেকে ওই নারীকে খাবার ও শীতবস্ত্র হিসেবে কম্বল দিয়েছেন। পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ওই নারীর পরিচয় নিয়ে পোস্ট দিলে মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে।


হাসপাতালের সামনে চা দোকানি হেদায়েত মিয়া জানান, ওই নারীর নাম রুমা বললেও বাড়ি কোথায় জানতে চাইলেই আদালত এলাকা ইঙ্গিত করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, আমার বাড়ি দূরে, আমি হাসপাতালের সামনে চা-পানের ব্যবসা করি। আমার স্ত্রী প্রতিদিন মানসিক ভারসাম্যহীন ওই নারীর জন্য রান্না করে ভাত-তরকারি বাটিতে ভরে দেন। সেই ভাত-তরকারি দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে আমি তাকে খাওয়াচ্ছি। ওই মেয়ে রাতে নিয়মিত খেলেও দুপুরের খাবার কখনো কখনো বিকেলে এসে খায়। আর সকালে চা-বিস্কুট দিয়ে নাস্তা করেন। আমি আমার পরিবারের সমর্থনে এবং সৃষ্টিকর্তার কৃপায় এই সেবাটুকু দিয়ে যাচ্ছি। যদি কেউ তাকে চিনে থাকেন তাহলে স্বজনদের মাধ্যমে এখান থেকে নিয়ে গিয়ে উন্নত চিকিৎসা করার ব্যবস্থা করবেন।

Advertisement


স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘ভয়েস অব ঝিনাইগাতী’ প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি জাহিদুল হক মনির বলেন, আমরা প্রথমে তার খোঁজ পেয়ে সেখানে যাই এবং আশপাশের মানুষদের সঙ্গে কথা বলি। আমরা প্রথমে এসে দেখি মানবেতর জীবনযাপন করছেন ওই নারী। পরে আমরা নিয়মিত খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি। ইতোমধ্যে তাকে শুকনো খাবার ও শীতবস্ত্র দিয়েছি।

মানবাধিকার সংস্থা ও এনজিও সৃষ্টি হিউম্যান রাইটস সোসাইটি’র সহকারী পরিচালক নাঈম ইসলাম বলেন, আমাদের একটি প্রতিনিধি দল ঝিনাইগাতী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে থাকা অজ্ঞাত ভারসাম্যহীন ওই নারীর খোঁজ-খবর নিয়েছে। শুকনো খাবার ও শীতবস্ত্র হিসেবে কম্বল দিয়েছি। পাশাপাশি বিভিন্নভাবে ওই নারীর স্বজনদের খোঁজে পেতে চেষ্টা করে যাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, ওই নারীর পরিচয় এখনো পাওয়া যায়নি। তবে তিনি ‘রুমা’ নাম ছাড়া আর কিছুই বলতে পারছেন না। আমাদের স্বেচ্ছাসেবীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে রুমার ছবিসহ পরিচয় জানতে চেয়ে পোস্ট দিয়েছেন। আশা করছি, দ্রুত সময়ের মধ্যেই আমরা তার পরিবারের খোঁজ পাবো এবং তার পরিবারের কাছে এই মেয়ে তুলে দিতে পারবো।

ঝিনাইগাতী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য সহকারী খাদিজাতুল জান্নাত বলেন, ওই নারী মানসিকভাবে অসুস্থ। তিনি অনেক কিছুই মনে রাখতে পারেন না। সকালে কথা বললে বিকেলেই ভুলে যান। আমরা মনে করি, তার উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন।

Advertisement


ঝিনাইগাতী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক আল আমিন বলেন, গত কয়েক মাস ধরেই এই পরিত্যক্ত অ্যাম্বুলেন্সেই এক প্রকার মানবেতর জীবনযাপন করছেন তিনি। তার বয়স ৩০/৩৫ বছর হতে পারে। আমরা প্রাথমিক চিকিৎসা দিলেও তার প্রয়োজন মানসিক চিকিৎসা সেবা, যা এই হাসপাতালে সম্ভব না।
শেরপুর জেলা সদর হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেলের (ওসিসি) জেলা কর্মকর্তা অমিত শাহরিয়ার বাপ্পী বলেন, আমি ঝিনাইগাতী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে পরিচয়হীন ওই নারীর সম্পর্কে জেনেছি। ওই নারী মানসিক প্রতিবন্ধী বলে চিকিৎসকরা নিশ্চিত করেছেন। যেহেতু আমরা অসহায় নারীদের নিয়ে কাজ করি, আমাদের পক্ষ থেকে ওই নারীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা সম্ভব। তবে, শেরপুরে যেহেতু সেইফ হোম নেই, তাই তাকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা দেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

ঝিনাইগাতী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বছির আহমেদ বাদল বলেন, ওই নারীর প্রকৃত নাম, পরিচয় ও ঠিকানা খোঁজা হচ্ছে। পরিচয় পাওয়া মাত্রই ওই নারীকে তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে।