সংসদ এলাকায় থাকছে না জিয়ার কবর

SHARE

ziarজাতীয় সংসদ ভবন এলাকা থেকে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবর সরিয়ে দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। স্থপতি লুই কানের নকশায় শেরেবাংলা নগর এলাকায় কবরস্থানের জন্য কোনো জায়গা রাখা হয়নি—এই যুক্তিতে জিয়াউর রহমানসহ সেখানকার আরও সাতটি কবর সরানোর পক্ষে মত দিয়েছে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়।
বাকি সাতটি কবর সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তার, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান ও আতাউর রহমান খান, সাবেক মন্ত্রী মশিউর রহমান যাদু মিয়া, মুসলিম লীগ নেতা খান এ সবুর, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক আবুল মনসুর আহমদ এবং পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকার তমিজউদ্দীন খানের।
এই আটটি কবর ছাড়া শেরেবাংলা নগরে আছে লুই কানের নকশাবহির্ভূত আরও সাতটি স্থাপনা। এগুলোর মধ্যে বড় স্থাপনা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র (বিআইসিসি), স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের বাসভবন। এর বাইরে চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়ার কবরের চারদিকে থাকা চারটি প্রবেশপথের শুরু বা শেষ প্রান্তে রয়েছে ঝুলন্ত সেতু, সম্মেলন কেন্দ্র ও মসজিদসহ চারটি স্থাপনা।|সর্বশেষ গত ২৭ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমদ মারা গেলে তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী সংসদ ভবনের ‘জাতীয় কবরস্থানে’ দাফন করার জন্য জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের কাছে অনুমতি চেয়েছিল তাঁর পরিবার। কিন্তু তাতে সম্মতি দেওয়া হয়নি। এর আগে জাতীয় সংসদ ভবন সীমানার পূর্ব প্রান্তে আসাদগেটের উল্টো দিকের পেট্রলপাম্পটি তুলে দেওয়া হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় তখনকার মন্ত্রী মির্জা আব্বাসের ভাইকে জায়গাটি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল।

মূল নকশা অনুযায়ী, সংসদ ভবন কমপ্লেক্সের পাশাপাশি নতুন সচিবালয়ও শেরেবাংলা নগরে হওয়ার কথা। কিন্তু বিএনপি সরকার সেখানকার ১০ একর জমিতে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র নির্মাণ করে, যা পরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র নামে নামকরণ করা হয়। এখন সরকার আবার সেখানে সচিবালয় স্থানান্তর করতে চাইলেও লুই কানের মূল নকশা হাতে না পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
জানতে চাইলে গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কবর তো বনানী, আজিমপুর বা মিরপুর কবরস্থানে হওয়ার কথা। কবর জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় হবে কেন? তা ছাড়া, লুই কানের নকশার কোথাও শেরেবাংলা নগরে কবরস্থানের জন্য জায়গা নির্ধারিত ছিল না।
গণপূর্তমন্ত্রী বলেন, ‘রাজনীতিবিদ হিসেবে আমি চট্টগ্রামের জন্য সাধ্যমতো কাজ করার চেষ্টা করেছি। আমি এখন মন্ত্রী। তাই বলে আমি মারা গেলে আমাকে কি এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে দাফন করতে হবে?’
এক প্রশ্নের জবাবে গণপূর্তমন্ত্রী বলেন, ‘আমি মনে করি, সংসদ এলাকা থেকে কবর ছাড়াও নকশাবহির্ভূত সব স্থাপনা সরানো উচিত। জাতীয় প্রয়োজনে মসজিদ-মাদ্রাসাও তো সরানো হয়।’ সে ক্ষেত্রে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের বাসভবন বা বিআইসিসি সরানো হবে কি না, জানতে চাইলে মোশাররফ হোসেন বলেন, মূল নকশা পাওয়ার পর সরকার এগুলো বিবেচনা করে দেখবে।
লুই কানের নকশা এড়িয়ে করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র, মসজিদ ও সম্মেলন কেন্দ্র, স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের বাসভবনসহ সাতটি স্থাপনা। আছে আরও সাতটি কবর

তবে বিএনপির নেতারা মনে করছেন, লুই কানের মূল নকশা আনা বা কবরগুলো সরিয়ে দেওয়ার মূল লক্ষ্য হচ্ছে জিয়াউর রহমানের কবর সরানো। জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক সেনাপ্রধান মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কেন সেখানে জিয়ার সমাধি করা হয়েছিল, কে করেছে বা কেন করেছে—এত দিন পর সেই প্রশ্ন অবাস্তব ও অবান্তর। এ দেশের মানুষ জানে, সেখানে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য কাজ করা একজন জাতীয় নেতার সমাধি আছে। ওটা সরালে গর্হিত কাজ হবে, সংঘাত ও প্রতিহিংসার নতুন বীজ বপন করা হবে।
শেরেবাংলা নগরে নকশাবহির্ভূত স্থাপনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সরকার লুই কানের মূল নকশা হাতে পেতে চায়, যা রয়েছে পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিটেকচার আর্কাইভসে। ওই নকশার একটি অনুলিপি সরকারের কাছে আছে। সংসদ সচিবালয় সূত্র জানায়, মূল নকশা সংগ্রহের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ৪ লাখ মার্কিন ডলার বরাদ্দ করা হয়েছে।
রাজনীতিবিদদের অনেকেই মনে করেন, সংসদ ভবনের সীমানায় জিয়াউর রহমানের দেহাবশেষ আনা হয়েছিল রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ও উদ্দেশ্যে। ১৯৮১ সালের ৩০ মে তাঁকে হত্যার পর প্রথমে দাফন করা হয়েছিল চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায়। পের সেখান থেকে তাঁর দেহাবশেষ তুলে এনে ২ জুন চন্দ্রিমা উদ্যানে কবরস্থ করা হয়। ২০০১ সালে জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়ার কবরকে কেন্দ্র করে পাঁচ বিঘা জমিতে সমাধি কমপ্লেক্স গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়। ২০০৩ সালে কাজ শুরু হয়, চলে ২০০৭ পর্যন্ত।
গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের একাধিক প্রকৌশলী জানান, ক্রিসেন্ট লেকের ওপরের ঝুলন্ত সেতু ও মসজিদ ছাড়া কোনো স্থাপনা সেই অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে না। জিয়ার কবরকেন্দ্রিক প্রায় সমাপ্ত বা অসমাপ্ত কাজগুলো সরকার আর এগিয়ে নিতে চায় না।
সরেজমিনে দেখা যায়, জিয়াউর রহমানের কবরস্থানে যাওয়ার জন্য ৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ক্রিসেন্ট লেকের ওপর নির্মাণ করা ঝুলন্ত সেতুটি প্রায় জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। ২০০৪ সালে এটি চালু হয়। ওই সেতু দিয়ে জিয়াউর রহমানের কবর পার হয়ে সোজাসুজি পথের শেষ ভাগে স্থাপন করা হয় ‘সম্মেলন কেন্দ্র’। দেখা যায়, সম্মেলন কেন্দ্রের দোতলায় মসজিদটি শুধু চালু আছে। ভবনকেন্দ্রিক অন্য পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়িত হয়নি।
গণভবনের দিক থেকে প্রায় ৪০০ ফুট পূর্বে জিয়াউর রহমানের কবরস্থানে প্রবেশের আরেকটি পথের পাশে রয়েছে একটি পরিত্যক্ত ভবন, যেখানে ক্যানটিন, বাথরুম ও খালি কক্ষ আছে।
বিআইসিসির দক্ষিণে রয়েছে আরেকটি ভবন, যেটির সঙ্গে জিয়ার কবরস্থানে যাতায়াতের সংযোগ রয়েছে। ওই ভবনে ক্যানটিন, বাথরুম ও সভাকক্ষ নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল। ভবনটির নির্মাণকাজ মাঝামাঝি পর্যায়ে এসে আটকে আছে।
এ প্রসঙ্গে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী কবির আহমেদ ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, লুই কানের মূল নকশা পাওয়ার পর এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, টাকা না থাকায় অসমাপ্ত কাজগুলো শেষ হয়নি।
এদিকে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে সংসদ ভবনের কাছে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের বাসভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। এই নির্মাণের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন ও স্থপতি ইনস্টিটিউট। ২০০৪ সালে হাইকোর্ট নির্মাণ স্থগিতের নির্দেশ দিলেও জোট সরকার কাজ চালিয়ে যায়। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভবন দুটির অসমাপ্ত কাজ শেষ হয়। তবে মামলাটি এখনো চলছে। ৪ নভেম্বর এই মামলার শুনানিতেই লুই কানের মূল নকশা তিন মাসের মধ্যে দাখিলের নির্দেশ দেন আদালত।
জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যে চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়াউর রহমানের কবর, তার নামও বারবার পাল্টেছে। নব্বই-পরবর্তী সময়ে যখন বিএনপি ক্ষমতায় ছিল, তখন এর নাম বদলে ‘জিয়া উদ্যান’ করেছে। আবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে পুরোনো নাম ‘চন্দ্রিমা উদ্যান’ ফিরিয়ে এনেছে। অন্তত চারবার এই নামবদলের ঘটনা ঘটেছে। আবার ক্রিসেন্ট লেকের ওপর প্রথম বেইলি সেতু করেছিল বিএনপি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তা সরিয়ে ফেলা হয়। এরপর বিএনপি আবার ক্ষমতায় এসে স্থায়ী সেতু তৈরি করে। আবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সেতুটি দিয়ে কিছুদিন যাতায়াত বন্ধ ছিল।
গত বছরের ১৭ জুন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় জিয়াউর রহমানের কবর চন্দ্রিমা উদ্যান থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার কথা বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ বছরের ৭ জুলাই একনেকের সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, সংসদ ভবনের ঐতিহ্য রক্ষার পাশাপাশি লুই কানের নকশা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কবরগুলো যদি সরানোর দরকার হয়, তাহলে সরকার তা করবে। এরপর এ বিষয়ে একটি প্রস্তাব তৈরি করে ১৪ জুলাই গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়।
আরও সাত কবর: পঁচাত্তর-পরবর্তী সময় থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত আটজন নেতা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিকে জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় কবর দেওয়া হয়েছে। তাঁদের মধ্যে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের পশ্চিম প্রান্তে পাঁচ বিঘা জমিতে ‘জাতীয় কবরস্থান’ নাম দিয়ে সাতজনকে সমাহিত করা হয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, সাতটির মধ্যে দুটি কবরের নামফলক নেই। তত্ত্বাবধায়ক আকবর হোসেন জানালেন, তাঁরা হলেন আবদুস সাত্তার ও শাহ আজিজ। তমিজউদ্দীন খান এবং খান এ সবুরের কবর শুধু পাকা করা হয়েছে। অন্যদের নাম, জন্ম ও মৃত্যুর সময় লেখা আছে সাইনবোর্ডে।
কবরগুলোর নিরাপত্তা রক্ষার জন্য একজন তত্ত্বাবধায়ক ও কয়েকজন পুলিশ রাখা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক প্রথম আলোকে বলেন, তিন বছর আগেও এই কবরস্থান উন্মুক্ত ছিল। এখন কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয় না।
সচিবালয় কমপ্লেক্স: ঢাকার যানজট নিয়ন্ত্রণ করতে বর্তমান সচিবালয় শেরেবাংলা নগরে স্থানান্তর করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। চন্দ্রিমা উদ্যানের উত্তরে ও বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের পশ্চিম পাশে যেখানে প্রতিবছর বাণিজ্য মেলা হয়, সেখানেই এখন অবশিষ্ট ৩২ একর জমির ওপরে নতুন সচিবালয় হওয়ার কথা। তবে গত ১৩ অক্টোবর একনেকের সভায় নতুন সচিবালয় কমপ্লেক্স স্থাপনের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে বলা হয়, মূল নকশা অনুযায়ী সবকিছু করতে হবে। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ২০৯ কোটি টাকা।
পাকিস্তান আমলে ১৯৬৪ সালে ১৫ মিলিয়ন ডলারের অনুমিত ব্যয় ধরে লুই কানের নকশা অনুযায়ী সংসদ ভবন কমপ্লেক্সটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। ৩২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে কমপ্লেক্সটির নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৯৮২ সালে।