আড়াইহাজারে প্রথম স্বাধীনতার পতাকা উড়ে এই দিনে

SHARE

647চলছে বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের পর পাক হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে সংগ্রামী জনতা এদেশকে স্বাধীন করেছে। জীবনবাজি রেখে পানির নিচে ডুব সাঁতার দিয়ে পিলারের নিচে ডিনামাইট ফিট করে পাঁচরুখী ব্রিজ উড়িয়ে দেয়ার মধ্য দিয়েই আড়াইহাজার উপজেলায় বিজয়ের সূচনা হয়। জেলায় প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ে আড়াইহাজারে। নারায়ণগঞ্জ জেলার মধ্যে প্রথম শত্রুমুক্ত হয়েছিল আড়াইহাজার থানা।

এদিকে, প্রতি বছর বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে দিনটি উপজেলার মুক্তিযোদ্ধারা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে থাকে। ১৯৭১ সালে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর আড়াইহাজার এলাকাটি শক্রমুক্ত হয়। উপজেলার পাঁচরুখী ব্রিজ, ডহরগাঁও এবং মেঘনা নদী দিয়ে বিভিন্ন এলাকা শত্রুমুক্ত করতে অপারেশন চালানো হয়। প্রবল প্রতিরোধের মুখে পাকবাহিনী ওই সময় আড়াইহাজার থানা এলাকা ছেড়ে ভুলতা দিয়ে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা থানা সদরের ডাক বাংলায় অবস্থিত পাক বাহিনীর ক্যাম্প দখল করে নেয়। সেই সঙ্গে স্বাধীন দেশের পতাকা উড়িয়ে আনন্দ উল্লাস করতে থাকেন।

বিশিষ্ট কবি সাহিত্যিক ও মুক্তিযোদ্ধা অনুপম হায়াৎ বলেন, নারায়ণগঞ্জ জেলার মধ্যে প্রথম শত্রুমুক্ত হয় আড়াইহাজার থানা। জেলায় প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ে আড়াইহাজারে। প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে পাকবাহিনী আড়াইহাজার ছেড়ে পালায়। থানা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এমএ সামাদ আড়াইহাজার সদরে অবস্থিত ডাকবাংলোতে স্থাপিত পাকবাহিনীর ক্যাম্প দখল করে নেন। সেই সঙ্গে স্বাধীন দেশের পতাকা উড়িয়ে আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়েন।

আড়াইহাজার থানা কমান্ডার স্থল ও জলপথ দু’দিক দিয়েই ডিসেম্বরের প্রথমে সদরের পাক সেনাদের ক্যাম্পে হামলার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। কমান্ডার এমএ সামাদ ছিলেন তখন পাকসেনাদের কাছে এক আতঙ্কের নাম। রাজাকার মারফত খবর পেয়ে পাক বাহিনীর চোখের ঘুম হারাম হয়ে যায়। ডিসেম্বরের ১ তারিখ থেকে ৭ তারিখ পর্যন্ত তারা ঠিকমতো ঘুমাতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ছিল ভরা বর্ষাকাল। কিন্তু নভেম্বর ও ডিসেম্বরে এসে চারিদিকে শুকনো মাঠ-ঘাট। অবশেষে মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়ে পাকবাহিনী রাতের আঁধারে পালিয়ে যায়। ৯ ডিসেম্বর সকালে আক্রমণ চালাতে এসে মুক্তিযোদ্ধারা দেখেন কেউ নেই। কিছু হাড়ি-পাতিল, চাল, ডাল ও আটার বস্তা পড়ে আছে। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এমএ সামাদ স্বাধীন দেশের পতাকা উড়িয়ে আড়াইহাজারে বিজয় ঘোষণা করেন। ‘সেই দিনটি ঈদের দিনের চেয়ে বেশি আনন্দের দিন ছিল। আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলাম। এই আমার দেশ। এই আমার দেশের মাটি। স্বাধীন করতে পেরেছি। দীর্ঘ ৪০ বছরের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন রণাঙ্গনের বীর সেনা আড়াইহাজার উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডার এম এ সামাদ।

বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী ওয়াজউদ্দিন স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘মফস্বল এলাকা বলে আড়াইহাজার থানা এলাকায় পাকবাহিনী মে ’৭১ইং মাসের শেষের দিকে ঢোকে। প্রথমেই আতঙাক সৃষ্টির জন্য তারা কয়েকটি গ্রাম থেকে হিন্দু মুসলমান মিলিয়ে ১৭ জন লোক ধরে নিয়ে যায়। কালীবাড়ি ব্রিজের পাশে (ঋষিপাড়ায়) খালপাড়ে সেই নিরীহ ১৭ গ্রামবাসীকে গুলি করে হত্যা করে। এখানে (ঋষিপাড়ায়) একটি গণকবর রয়েছে। মে মাসে পাঁচরুখী গ্রামে পাকবাহিনী আরও একটি গণহত্যা চালায়। ১৬ গ্রামবাসীকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়। পাঁচরুখীতেও একটি গণকবর রয়েছে। দুটি গণহত্যা চালিয়ে পাকবাহিনী ফিরে যায়। তারা প্রথমবার আড়াইহাজারের ভেতরে প্রবেশ করেনি। এরই মধ্যে মুক্তিকামী যুবক শ্রেণি যে যার মতো ভারতে চলে যায় ট্রেনিং এর জন্য।

বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. লাল মিয়া বলেন, মে মাসে ট্রেনিং নিতে ভারতে যাই। ভারতের মেলাঘর এলাকায় ২নং সেক্টর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফ আমাদের ট্রেনিং দেন। টুআইসি ছিলেন মেজর হায়দার। আমরা ২২ জন যুবক ট্রেনিং শেষ করে অস্ত্রসস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে আগস্টের প্রথমে দেশে ফিরে আসি। এরই মধ্যে জুলাইয়ের প্রথম দিকে আড়াইহাজার থানা সদর ও ডাকবাংলোতে পাকহানাদার বাহিনী স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করেছে। বিভিন্ন গ্রামে শান্তিবাহিনীও গঠিত হয়েছে। রাজাকার আলবদরদের অপকর্ম চলছে। পাক বাহিনীর স্থায়ী ক্যাম্প করার কারণও জানা গেল।

জুনের শেষের দিকে গিয়াস উদ্দিনের (বীর প্রতীক) নেতৃত্বে নারায়ণগঞ্জের একদল মুক্তিযোদ্ধা আড়াইহাজার থানায় দুঃসাহসিক অপারেশন চালিয়েছিল। নারায়ণগঞ্জের সেই গ্রুপের সঙ্গে ঝাউগড়ার মুক্তিযোদ্ধা সিরাজও ছিল। এই অপারেশনের পর আড়াইহাজার থানা সদরে পাক মিলিটারি বাহিনী স্থায়ী ক্যাম্প করে। মুক্তিযোদ্ধাদের ধ্বংস করে দেয়ার জন্যই তাদের কার্যক্রম চলতে থাকে। কিন্তু আগস্টে ভারত থেকে ফিরে মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হয়।

মুক্তিযোদ্ধা লাল মিয়ার ভাষায়, ‘আমরা ২২ জন মুক্তিযোদ্ধা কুমিল্লার চারগাছা দিয়ে দেশে ঢুকি। নৌকাযোগে মাহমুদপুর ইউনিয়নের গহরদী গ্রামে তাইজুদ্দিন চেয়ারম্যানের বাড়িতে উঠি। সেখানে এক রাত থাকি। পরদিন আড়াইহাজার থানা কমান্ডার এমএ সামাদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। অন্যান্য গ্রুপের সঙ্গে পরিচয় হয়। আমাদের ২২ জনের গ্রুপের কাছে যে সকল অস্ত্রসস্ত্র ছিল তা হলো- ৪টি থ্রি নট থ্রি রাইফেল, ৫টি মার্কফো রাইফেল, ২টি এসএমজি, ২টি এলএমজি, টুইন্সমর্টার ২টি, থ্রিইন্স মর্টার ২টি, ল্যান্ডমাইন ৫টি, হ্যান্ড গ্রেনেড ১০০টি, স্টেনগান ৩টি, এক্সক্লুসিভ ২২ কার্টুন ও বিভিন্ন গুলি ২২ কার্টুন।

থানা কমান্ডার এমএ সামাদ আড়াইহাজার থানা এলাকাকে ২ ভাগে ভাগ করে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। একটি পূর্ব অঞ্চল অপরটি পশ্চিম অঞ্চল। পূর্ব অঞ্চলে ছিল নদীপথ এবং পশ্চিম অঞ্চলে ছিল স্থলপথ (ঢাকা-সিলিট মহাসড়ক)। স্থলপথের জন্য (পশ্চিম অঞ্চল) দায়িত্বে ছিলেন খালিকুজ্জামান মোল্লা। পূর্বে (নদীপথে) দায়িত্বে ছিলেন আহসান উদ্দিন মোল্লা। প্রায় ৪০০ মুক্তিযোদ্ধা জীবন বাজি রেখে পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চল রক্ষা করেছেন। আড়াইহাজারে ৫টি বড় ধরনের যুদ্ধের পাশাপাশি বেশ কিছু ছোটখাটো অপারেশনও হয়েছে। ৫টি বড় অপারেশনের মধ্যে স্থলপথে ৪টি এবং নদীপথে ১টি যুদ্ধ হয়েছে।