ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),বিশেষ প্রতিনিধি, বৃহস্পতিবার ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ || মাঘ ৩০ ১৪৩১ :
রাজধানীর পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের পেছনে বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে ২৪ ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে কয়েকটি নৌযান। যেগুলো নদীতে চলাচলের পরিবর্তে মানুষের থাকার উপযোগী করে রূপ দেওয়া হয়েছে ভাসমান আবাসিক হোটেলে (বোর্ডিং)। যাতে সর্বনিম্ন ৪০ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১০০ টাকা ভাড়ায় থাকা যাবে পুরো একটি দিন। সেই পাকিস্তান আমলে এসব বোর্ডিংয়ের যাত্রা শুরু হলেও এখনো টিকে আছে মাথা উঁচু করে। সাধারণত রাজধানীর আবাসিক হোটেলগুলোতে থাকার জন্য যেসব সুযোগ-সুবিধা রয়েছে তার প্রায় সবই আছে এই বোর্ডিংগুলোতে। প্রতিটি ভাসমান বোর্ডিংয়ে কক্ষ আছে ৩০-৩৫টি। বৈদ্যুতিক আলো, নিরাপদ খাবার পানি, টয়লেটসহ বোর্ডারদের জন্য রয়েছে আরও বেশ কিছু সেবা।
Advertisement
লোকমুখে জানা যায়, ১৯৬০-এর দশকে বেশ জমজমাট ছিল এই বোর্ডিংগুলো। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হিন্দু ব্যবসায়ীরা ব্যবসায়ের কাজে ঢাকায় যাতায়াত করতেন। তারা ঢাকা শহরে মুসলমানদের মালিকানাধীন কোনো হোটেলে উঠতে চাইতেন না। আর হোটেলের সংখ্যাও ছিল কম। এসব হিন্দু ব্যবসায়ীর কথা মাথায় রেখে ঢাকার কিছু হিন্দু মহাজন বুড়িগঙ্গায় ভাসমান বোর্ডিংগুলো তৈরি করেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় হিন্দু মালিকরা ব্যবসা ছেড়ে ভারতে চলে যান। পরে বোর্ডিংগুলো কিছু মুসলিম ব্যবসায়ী বুঝে নেন। বোর্ডিংগুলো প্রথমে সদরঘাট এলাকায় ছিল। কয়েক বছর আগে এগুলো মিটফোর্ড ঘাটে স্থানান্তর করা হয়েছে। নিরাপত্তার স্বার্থে বোর্ডিংগুলো রাত ১২টার পর থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয়। প্রতিটি বোর্ডিংয়ের দায়িত্বে থাকেন একজন করে ব্যবস্থাপক (ম্যানেজার)। শুরুর দিকে এগুলো ছিল কাঠের তৈরি। নব্বইয়ের দশকের পরে সংস্কার করে লোহা দিয়ে তৈরি করা হয় এগুলো। কয়েক বছর পর পর এই নৌযানগুলো ডকইয়ার্ডে পাঠিয়ে সংস্কার ও মেরামত করা হয়ে থাকে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সদরঘাট ও এর আশপাশের এলাকায় প্রচুর ভাসমান মানুষ রয়েছেন। যাদের থাকার নির্দিষ্ট কোনো জায়গা নেই। আবার বেশি টাকা খরচ করে আবাসিক হোটেলে থাকার সামর্থ্যও নেই তাদের। তারাই মূলত থাকেন এই বোর্ডিংগুলোতে। এ ছাড়া বুড়িগঙ্গার আশপাশের হকার এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও চাকরিজীবীরাও থাকেন এসব বোর্ডিংয়ে। যারা সারা দিন বিভিন্ন কাজকর্মে ব্যস্ত থাকেন। দিন শেষে এখানে এসে নির্বিঘে রাত যাপন করেন।
Advertisement
সরেজমিনে বুড়িগঙ্গা তীরের মিটফোর্ড ঘাটে দেখা যায়, উজালা, ফরিদপুর, শরীয়তপুর ও বুড়িগঙ্গা নামে চারটি ভাসমান বোর্ডিয়ে রাত যাপনের ব্যবস্থা রয়েছে। ভাসমান বোর্ডিংয়ে ওঠানামার জন্য নদীর তীর থেকে রয়েছে বাঁশ ও কাঠের তৈরি সাঁকো। ভাসমান বোর্ডিংগুলোতে কেবিনের পাশাপাশি রয়েছে ঢালা বিছানার ব্যবস্থা। প্রতিটি কেবিনের ভাড়া ১০০ টাকা। এ ছাড়া যারা মেঝেতে ঢালা বিছানা করেন, তিন-চারজন একসঙ্গে থাকেন, তাদের ভাড়া গুনতে হয় জনপ্রতি মাত্র ৪০ টাকা করে। প্রতিটি কেবিনে রয়েছে তোশক, কাঁথা, বালিশ, ফ্যান ও লাইট। একেকটি বোর্ডিংয়ে ৪০-৫০ জনের মতো থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে বোর্ডিংগুলোতে শুধু পুরুষরাই থাকতে পারে।
বোর্ডিংয়ে নিয়মিত রাত যাপন করা মামুন নামে এক হকার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সারা দিন পরিশ্রম করার পর রাতে নির্বিঘ্নে এ হোটেলে থাকতে পারি। ঢাকায় কোনো বাসাবাড়ি নাই, পরিবার থাকে গ্রামে। মেসে থাকার চেয়ে এখানে থাকার সুযোগ-সুবিধা বেশি, তাই এখানেই থাকি। আর টাকাও খুব কম লাগে। সবচেয়ে বড় কথা, আমার সাধ্যের মধ্যে সবটুকু সুখ পাই এখানে, কোনো প্রকার ঝামেলাও নাই।’ মো. সবুজ নামে আরেক বোর্ডার বলেন, ‘আমি দীর্ঘ ১২ বছর ধরে এই বোর্ডিংয়ে থাকি। যখন প্রথম উঠছিলাম, তখন ভাড়া ছিল ৩০ টাকা। প্রতিবছরই ১০ টাকা, ৫ টাকা করে ভাড়া বাড়াচ্ছে। এখন ১০০ টাকা হয়েছে। যখন বাড়িতে যাই, তখন কোনো ভাড়া লাগে না। থাকলে ভাড়া, না থাকলে ভাড়া নাই।’
Advertisement
বোর্ডিংয়ের গ্রাহক সংখ্যা আগের চেয়ে কমে গেছে বলে জানান উজালা নামে একটি বোর্ডিংয়ের কর্মী ফরিদ। তিনি বলেন, ‘আগে আমাদের বোটগুলো সদরঘাট, ওয়াইজঘাট বরাবর ছিল। ওইখানে আমাদের অনেক কাস্টমার ছিল। বিআইডাব্লিউটিএ তাদের সুবিধার জন্য আমাদের বোটগুলো ওইখান থেকে এখন মিটফোর্ডে নিয়ে আসার কারণে পুরাতন কাস্টমাররা অনেকেই চেনে না। ফলে এখন কাস্টমার কমে গেছে।’
রাজধানীতে ৪০ টাকায় রাত যাপন