ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম,(টিভি),সুন্দরবন প্রতিনিধি, মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১ : বাঘের আক্রমণে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। গত ১৫ বছরে প্রায় ৫০-৬০ বার লোকালয়ে আক্রমণ করেছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার। সবশেষ গত ২০ এপ্রিল সুন্দরবনে মধু আহরণ করতে গিয়ে সাতক্ষীরা রেঞ্জের নোটাবেকির বিপরীতে ভারতীয় অংশে বাঘের আক্রমণে প্রাণ গেছে মনিরুজ্জামান বাচ্চু নামের এক মৌয়ালের। শেষ কয়েক বছর প্রায়ই শোনা যাচ্ছে ঘন ঘন লোকালয়ে আসছে বাঘ। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, বাঘ লোকালয়ে আসছে কি মানুষ খেতে?
সুন্দরবনের আশপাশের গ্রামগুলোতে থাকা প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, অনেক সময় এমন হয় গ্রামের বাড়িতে গরু, ছাগল, মহিষ খোলা স্থানে বাঁধা থাকে। কিন্তু বাঘ পাশ থেকে হেঁটে গেলেও তাদের ওপর আক্রমণ করে না।
Advertisement
পৃথিবীর সবচেয়ে ভিন্নতর বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০ বছর ধরে ম্যানগ্রোভ বনে টিকে আছে বাঘ। বাঘের দ্বিতীয় বৃহত্তম উপপ্রজাতি বেঙ্গল টাইগার বা রয়েল বেঙ্গল টাইগার যার বৈজ্ঞানিক নাম Panthera tigris tigris বা Panthera tigris bengalensis । গোটাবিশ্বে প্রায় ৪,৫০০ বাঘের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বাঘ রয়েছে সাইবেরিয়ায়। যা প্রায় ৬০০ এর কাছাকাছি। ধারণা করা হয়, এর পরেই রয়েছে সুন্দরবন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৯ সালে ১৫ জন মানুষ এই বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন। এর বাইরে কতবার লোকালয়ে বাঘ এসেছে-গেছে তার হিসাব দেয়া অবশ্য মুশকিল। লোকালয়ে বাঘের এমন উপস্থিতিতে মানুষ ও বাঘের লড়াইও ঘটেছে বহুবার। এতে প্রাণ গেছে মানুষের, সঙ্গে বাঘেরও।
লড়াইয়ে যাচ্ছে মানুষ ও বাঘের প্রাণ
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের হিসাব মতে, ২০০৪ সালের জরিপ অনুসারে সুন্দরবনে বাঘ ছিল ৪৪০টি। ২০১৮ সালের জরিপে দেখা যায়, তা কমে হয়েছে ১১৪টি। ২০০১ থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত সুন্দরবনে বাঘ মারা গেছে কমপক্ষে ৪৬টি। এর মধ্যে প্রাকৃতিক কারণে মরেছে ৮টি বাঘ। বিভিন্ন সময় শিকারিদের হাতে মৃত্যুবরণ করেছে ১৩টি বাঘ। লোকালয়ে প্রবেশ করায় স্থানীয়দের হাতে মারা গেছে ৫টি বাঘ।
তবে বন বিভাগের ধারণা, বর্তমানে বাঘের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। তাহলে কি সুন্দরবনে জায়গা সংকুলান হচ্ছে না রয়েল বেঙ্গল টাইগারের? খাদ্যের অভাবে লোকালয়ে হানা দিচ্ছে বাঘ?
Advertisement
৩২ বছরে গেছে ২৪০০ বাঘের প্রাণ
একটা সময় ছিল, যখন হাজার হাজার মানুষ বাঘের আক্রমণে মারা যেত এবং তখন রাজারা বাঘ হত্যা করলে পুরস্কার ঘোষণা করতেন। ১৮৮৩ সালে প্রথম বাঘ মারতে পারলে ৫০ রুপি পুরস্কার ঘোষণা করা হয় এবং ১৯০৬ সালে এসে তা চারগুণ করা হয়। ভারতের বনবিভাগের তথ্যমতে, ১৮৮১ থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত ২৪০০ বাঘ মারা হয়েছে।
কেন নিজ এলাকা ছেড়ে লোকালয়ে বাঘ?
বনকর্মী এবং স্থানীয়দের দেয়া তথ্যমতে, বিভিন্ন কারণে বাঘ তার নিজের এলাকা ছেড়ে অন্য কোথাও যায়। প্রথমত, বাঘের নিজস্ব একটা এলাকা থাকে। শাবক বাঘ যখন বড় হয়, তখন তার বাবা-মাকে ছেড়ে নিজস্ব এলাকা বাছাই করার সন্ধানে বের হয়। তখন অনেক সময় পথ ভুল করে ঢুকে পড়ে লোকালয়ে।
বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ এস ওয়াই মন্টগোমারি তার ‘স্পেল অব টাইগার: দ্য ম্যান ইটার্স অব সুন্দরবন’ বইতে উল্লেখ করেছেন, বাঘ তার নিজস্ব এলাকা ছাড়া অন্য যেকোনও এলাকায় খুব ভীতসন্ত্রস্ত থাকে এবং অচেনা অজানা এলাকায় তার শক্তিমত্তা নিয়ে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। লোকালয়ের গরু-ছাগল আক্রমণ করাও তার জন্য সাহসী পদক্ষেপ। কিন্তু বিপত্তি বাধে যখন লোকালয়ের মানুষের আক্রমণের শিকার হয় বাঘ। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে তখন বাঘ আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে, আত্মরক্ষার স্বার্থে। এ সময় বাঘের আক্রমণে প্রাণ যায় মানুষের।
তবে প্রকৃতিগতভাবে মানুষের মাংসের ভক্ত হয়ে ওঠার একটা ব্যাপার থেকে যায়। সুন্দরবনে গহীনে অসংখ্য মৌয়াল মধু সংগ্রহ করতে ঢোকে। আর নিজ এলাকার যেকোনও চলমান প্রাণীকে বাঘ তার শিকার মনে করে। আর হরিণ বা বন্য শূকরের তুলনায় মানুষ অনেক দুর্বল শিকার। যে কারণে একবার মানুষের রক্ত-মাংসের স্বাদ পেলে বাঘের এক ধরনের অভ্যস্ততা তৈরি হতে পারে। অনেকে বলে থাকেন, পৃথিবীতে সুন্দরবনের বাঘ একমাত্র বাঘের প্রজাতি যা মানুষখেকো হয়ে উঠতে পারে। এ কারণে লোকালয়ে আসতে পারে।
Advertisement
জলাবায়ু পরিবর্তনে কি মানুষখেকো হচ্ছে বাঘ?
আবার অনেকের মতে, মূলত বাঘ শুষ্ক অঞ্চলের প্রাণী হলেও সুন্দরবনের লবণাক্ত পানির ভেতর, তুলনামূলক কম খাদ্যের আধারের মধ্যেও টিকে আছে তারা। এই নোনা পানি খেয়েই এখনও অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার।
এ অবস্থায় লবণাক্ত পানিও কিন্তু বাঘের লোকালয়ে আসার কারণ, বলছেন বাঘ গবেষকরা। সমুদ্র উপকূলে অবস্থিত বলে সুন্দরবনের অপেক্ষাকৃত লবণাক্ত পানি বাঘ খেতে পারে না। মনে করা হয়, মিষ্টি জলের অভাবে বিরক্ত হয়ে বাঘ ধীরে ধীরে হিংস্র হয়ে ওঠে।
তাছাড়া ভারত-বাংলাদেশ মিলিয়ে প্রায় ১৩৩০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের সুন্দরবনের ৬০ ভাগ পড়েছে বাংলাদেশ সীমার ভেতর। আর সুন্দরবনে রয়েছে অসংখ্য দ্বীপ। সুতরাং লোকালয় থেকে দূরত্ব মাত্র বনের ভেতর এঁকেবেঁকে চলা এইসব ছোট ছোট চ্যানেলগুলো। সুন্দরবনের ভেতরের যেসব প্রাকৃতিক জলাধারসমূহ যুগ যুগ ধরে বাঘসহ বন্য প্রাণীদের মিঠা পানির চাহিদা মিটিয়েছে, সে সব জলাধার যুগ যুগ ধরে বাঘসহ অন্য প্রাণীর মিঠা পানির চাহিদাও মিটিয়েছে। তবে সেসব জলাধার সিডর ও আইলাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে মারাত্মকভাবে লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। আর তাই মিঠা পানির খোঁজে লোকালয়ে ধাবিত হতে পারে বাঘ।
লোকালয়ে ঢুকে পড়া নিয়ে আরেকটি তত্ত্ব দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। সেটি হলো, প্রতিদিন একটি বাঘের ১৮-৫০ কেজি খাবার প্রয়োজন হয়। সাধারণত একটি পূর্ণ বয়স্ক স্ত্রী বাঘ ১৪ থেকে ১৬ কিলোমিটার ও একটি পুরুষ বাঘ ৩৫ তেকে ৩৬ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে বিচরণ করে থাকে। এর মধ্যে অন্য কোন বাঘ ঢুকে পড়লে আগে বিচরণ করা বাঘটির সঙ্গে তার সংঘাতের সৃষ্টি হয়। এতে পরাজিত বাঘটি বনের কাছাকাছি কোনো লোকালয়ে ঢুকে পড়ে। বয়স্ক বাঘও দিনের পর দিন বনের মধ্যে শিকার করতে না পেরে খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে ঢুকে পড়ে মানুষসহ গবাদিপশুর ওপর হামলা চালায়।
এদিকে জার্মান বাঘ বিশেষজ্ঞ রোনাল্ড হেন্ড্যাকে, মার্কিন পরিবেশবিদ মর্গান ও ম্যাক ইন্টারের গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, সুন্দরবনের পানি ও মাটিতে লবণের পরিমাণ বাড়ায় বাঘের নরখাদক হওয়ার আশঙ্কা খুবই বেশি। মানুষের মাংস মিষ্টি, তাই বাঘের দৃষ্টি সেদিকে থাকে।
তবে ভারতের ওয়াইল্ডলাইফ ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী যদভেন্দ্রদেভ বলছেন, সুন্দরবনের বাঘ ইচ্ছাকৃতভাবে লোকালয়ে প্রবেশ করে না। নিহতের ঘটনা লোকালয়ে ঘটে না বললেই চলে। কেবলমাত্র মৌয়াল কিংবা বনের ভেতরে মানুষের অনধিকার প্রবেশের কারণেই মানুষ বাঘের আক্রমণের শিকার হয়।
বাঘ গবেষকরা বাঘের আচরণের নানা দিক তুলে ধরে আরও বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নদীতে পলি জমা হচ্ছে। এতে ভাটার সময় নদীর পানি কমে গিয়ে সহজ হচ্ছে বাঘের বিচরণপথ। এছাড়া অবৈধ শিকারিদের হামলায় প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠছে বাঘ। কুয়াশাজনিত কারণেও বিড়াল প্রজাতির এ প্রাণী পথ হারিয়ে লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে।
চাইলেই বাঁচে প্রাণ
তবে চাইলেই কিন্তু বাঘের অবাধ বিচরণ এবং লোকালয়ে ঢুকে পড়া নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এতে মানুষ ও বাঘ উভয়েরই প্রাণ বাঁচে। নাইলনের বেড়া দিয়েও বাঘকে নির্দিষ্ট এলাকায় রাখা সম্ভব। মনস্তাত্ত্বিক কারণে বাঘ এ ধরনের ঘেরাও অতিক্রম করে না। লোকালয়ে এলে যেমন হুমকির মুখে পড়ে মানুষ, তেমনি বাঘও।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন বিভাগের উচিত বাংলাদেশের গর্ব এই ম্যানগ্রোভ বনের সম্পদ এসব বন্যপ্রাণীদের জন্য নিরাপদ ও উপযুক্ত আবাসস্থল নিশ্চিত করা।
Advertisement
বিশেষত খাদ্যশৃঙ্খলের একদম সর্বোচ্চ পর্যায়ের খাদক এই রয়েল বেঙ্গল টাইগার বাঁচলে ভারসাম্য বজায় থাকবে খাদ্যশৃঙ্খলে। বেঁচে থাকবে অন্য বনাঞ্চলের চেয়ে অধিক কার্বণ শোষণকারী ম্যানগ্রোভ বন, আমাদের গর্বের সুন্দরবন।