ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),আমেরিকা প্রতিনিধি, বৃহস্পতিবার ২৮ আগস্ট ২০২৫ || ভাদ্র ১৩ ১৪৩২ :
আমেরিকার এখনকার একজন মুসলমানের অনুভূতি বুঝতে চাইলে আপনাকে উইসকনসিনের শেবোগান কাউন্টির ডাক্তার মনসুর মির্জার জায়গায় নিজেকে কল্পনা করতে হবে। ফেব্রুয়ারির এক সন্ধ্যায় আপনি উইলসনের পরিকল্পনা কমিশনের এক বৈঠকে উপস্থিত। ওস্টবার্গের নিকটবর্তী একটি গ্রামে একটি মসজিদ নির্মাণের অনুমতি চেয়ে করা আপনার আবেদনটি বিবেচনা করছে এ পরিকল্পনা কমিশন। বৈঠকে আপনি তার তেমন বিরোধিতা প্রত্যাশা করছেন না। মসজিদের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পত্তি ইতোমধ্যেই আপনি সংগ্রহ করেছেন এবং গত পাঁচ বছর ধরে আপনি নিকটবর্তী ম্যানিটোভোক হাসপাতালে কর্মরত রয়েছেন। আপনি এ শহরে কোনো আগন্তুকও নন। উপরন্তু বৈঠকে উপস্থিত রয়েছেন এমন কিছু মানুষ যারা আপনার বেশিরভাগ শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান রোগীর মতো ডাক্তারের কাছে তাদের অসুস্থতার কথা বলতে গেলে ডাক্তারের ধর্ম, বর্ণ ইত্যাদি বিষয়গুলো মনে রাখেন না।
Advertisement

কিন্তু বৈঠকের আলোচনা শুরু হলে আপনি এমন ধরনের কথা শুনতে পেলেন যেগুলো তারা আপনাকে কখনো বলেনি। এমনকি ব্যক্তিগত রোগনির্ণয় কক্ষেও তারা কখনো এ ধরনের কথা বলেনি। একের পর এক তারা আপনার প্রস্তাবের প্রতি তাচ্ছিল্য দেখালেন ও তার বিরোধিতা করলেন। তাদের বেশিরভাগ বিরোধিতাই নগর পরিকল্পনার সঙ্গে সঙ্গত নয়। সেগুলো আপনার ধর্মীয় অনুভূতির সঙ্গে জড়িত। তারা বলেন, ইসলাম একটি ঘৃণিত ধর্ম। ক্রিশ্চিয়ানিটি নিশ্চিহ্ন করতে মুসলমানরা উঠে পড়ে লেগেছে। আমেরিকার গ্রামাঞ্চলে ২০ টি গোপন জিহাদি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প রয়েছে। ভবিষ্যতে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালানোর জন্য সেগুলো এখনো সন্ত্রাসী তৈরি করছে।
মুসলমানরা তাদের সন্তানদের হত্যা করছে। খ্রিস্টান ছেলে-মেয়েরা নেশা, অ্যালকোহল ও পর্নোগ্রাফী নিয়ে যথেষ্ট সমস্যায় রয়েছে এবং ইসলাম নিয়েও উদ্বিগ্নতা সৃষ্টি করা উচিত নয়। একজন বলেন, “আমি আমার আঙিনায় এটা চাই না।” অন্য একজন বলেন, “আমি কেবল চিন্তা করি এটা কি আমেরিকা নয়।”
বৈঠকে শুধু এক দম্পতি একটু শান্তভাবে কথা বলেন। টাইম ম্যাগাজিনের পাওয়া বৈঠকের একটি অংশের আলোচনায় দেখা যায়, ঐ দম্পতির একজন বলেন, “আমি মনে করি না যে, সাধারণীকরণ করে আমাদের বিষয়টিকে এতো বড় করে দেখা উচিত।” কিন্তু বৈঠকে ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি অন্ধভাবে সন্দেহ ও বিদ্বেষ প্রকাশ থামাতে তা যথেষ্ট ছিল না। মির্জা কথা বলার সময় তার কণ্ঠে চরম আঘাত ও কষ্টের সুর স্পষ্টত ফুটে ওঠে।
তিনি বলেন, “আমরা যদি সেখানে প্রার্থনা করি তাহলে কাউকে বিরক্ত করব না। আমরা গোলমাল করব না। আমরা শুধু সেখানে গিয়ে প্রার্থনা করব এবং চলে আসব।” মসজিদে কোনো অস্ত্র বা জঙ্গি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থাকবে কিনা–বলে একজন কমিশনার জানতে চাইলে তিনি চুপ থাকেন। কিন্তু পরক্ষণেই পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ৩৮ বছর বয়সী মির্জা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তিনি বলেন, “যেসব মানুষ হাসপাতালে এসে শ্রদ্ধার সঙ্গে আমার কাছে চিকিৎসা নেয় তারা আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলতে পারবে তা আমি কখনো প্রত্যাশা করিনি।” তখন তার আইনজীবী তাকে শান্ত করতে পার্শ্ববর্তী ক্যাফেতে নিয়ে যান।
শেবোগান কাউন্টিতে মির্জার কিছু মুসলমান অনুসারীর মতে, তিনি অত্যন্ত সহজ সরল মানুষ। সেখানকার অধিকাংশ মুসলমান বসনিয়ান এবং আলবেনিয়ান যারা যুগোশ্লাভিয়া ভাঙার পর সার্বদের নির্যাতন থেকে রক্ষা পেতে আমেরিকায় পালিয়ে যান। স্বদেশের তিক্ত অভিজ্ঞতার জন্য সেখানে যাতে আর ফিরতে না হয় সেজন্য তাদের অনেকে ধর্মীয় বিশ্বাস গোপন রাখে। একটি মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা তাদের কমিউনিটির দিকে নজরদারি সৃষ্টি করতে পারে বলে তাদের ভয় থাকে।
তাদের আশঙ্কা একেবারে মিথ্যা ছিলো না। মসজিদ নিয়ে ঐ বৈঠকের পর ওস্টবার্গের গির্জার যাজকরা এ পরিকল্পনার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে শুরু করে। রেভারেন্ড ওয়েন ডেভ্রু নামের ওস্টবার্গের এক গির্জার যাজক বলেন, “ইসলামের রাজনৈতিক শিক্ষা হলো, বিশ্বে তার ধর্মীয় অনুশাসনের আধিপত্য বিস্তার এবং স্বৈরতান্ত্রিকভাবে অন্য সব ধর্মের ওপর আধিপত্য বজায় রাখা।”
নিউইয়র্কের গ্রাউন্ড জিরোর দুই ব্লক দূরে মুসলিম সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও মসজিদ নির্মাণ পরিকল্পনার বিরোধিতায় নিউইয়র্কে বিক্ষোভ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত উইলসনে মসজিদ নির্মাণের এ দ্বন্দ্ব আমেরিকাবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলো। সুফিবাদী ধারায় ইসলাম ধর্মীয় বাণী প্রচারের জন্য আমেরিকায় সুপরিচিত ইমাম ফয়সাল রউফ ও তার স্ত্রী ডেইজি খানের পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টুইন টাওয়ারে আল কায়েদার সন্ত্রাসী হামলাস্থলের কাছে এ মুসলিম সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও মসজিদ নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্পটি পার্ক৫১ নামে পরিচিত। তাদের পরিকল্পনা নিউইয়র্ক নগর কর্তৃপক্ষ অনুমোদন দিয়েছে এবং মেয়র মাইকেল ব্লুমবার্গও তাদের পরিকল্পনার পক্ষে রয়েছেন। তবে সারা দেশে এ পরিকল্পনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে।
কিছু বিরোধিতাকারী দাবি করছে, গ্রাউন্ড জিরোর পাশে ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ করলে তা ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত প্রায় ৩ হাজার মানুষের পরিবারের সদস্যদের অনুভূতিতে আঘাত হানবে। সে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত মার্গারেটের ভাই পল উইলার যিনি পেশায় একজন আইনজীবী তিনি স্বীকার করেন যে, রউফ ও খানের সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে সেখানে ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও মসজিদ নির্মাণের। তবে তিনি আরো বলেন, “আমি মনে করি না যে, এটা সঠিক পদক্ষেপ।”
Advertisement

অনেক মার্কিনীর মতো গ্রাউন্ড জিরোর চারপাশের এলাকা পরম শ্রদ্ধেয় বিবেচনা করে ইসলামের বিরুদ্ধে মনোভাব থাকা উচিত নয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে রিপাবলিকান নেতা নিউট গিংগ্রিচ ও সারাহ পেলিনের কল্যাণে আগামী নভেম্বরে একটা গুরুত্বপূর্ণ কংগ্রেস নির্বাচনের আগ মুহূর্তে স্পর্শকাতর এ বিষয়টি একটি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। বিতর্ক বাড়তে থাকায় প্রকল্পটি একটি কঠিন পরীক্ষায় পরিণত হয়েছে। আর তা ব্যক্তিগত সম্পত্তি অধিকার থেকে ধর্মীয় সহনশীলতা সব বিষয় নিয়ে বিতর্ক তুলেছে। তবে পার্ক ৫১’র অনেক বিরোধিতাকারী আবার উইসকনসিনের অনেক বিরোধিতাকারীর মতো ইসলাম-ফোবিয়ায় ভোগা শুরু করেছে।



