যেভাবে ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন হাত বদল

SHARE

ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন হাত বদল

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),ঢাকা প্রতিনিধি,বুধবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২১ : ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির অধীনে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক অনুষ্ঠিত পাঁচ ব্যাংকের ১ হাজার ৫১১টি অফিসার (ক্যাশ) শুন্য পদের বিপরীতে গত ৬ নভেম্বর অনুষ্ঠিত পরীক্ষায় ১ লাখ ১৬ হাজার ৪২৭ জন চাকরিপ্রত্যাশীরা অংশ গ্রহণ করেন। কিন্তু পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই ফাঁস হয়ে যায়। এতে নড়েচড়ে বসে গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের সদস্যরা।

ব্যাংকের নিয়োগ প্রশ্নপত্র তৈরি ও পুরো পরীক্ষা সম্পাদনের দায়িত্বে ছিল আহসানুল্লাহ ইউনির্ভার্সিটি অব সাইন্স অ্যান্ড টেকনলোজি। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মচারীর কাছে ৫০ হাজার টাকায় প্রশ্নপত্র কেনা হয়। কয়েক হাত ঘুরে প্রশ্নপত্র জনতা ব্যাংক কর্মকর্তা সোহেল রানার হাতে পড়ে। তিনি ২ কোটি ৮০ লাখ টাকায় প্রশ্নপত্র কিনে নেন। এই প্রশ্ন পরীক্ষার্থীদের কাছে সরবরাহ করে প্রায় ২০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল সোহেলের।

গত রোববার রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকা থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সদস্য মিজানুর রহমান মিজানকে গ্রেপ্তারের পর গত সোমবার আদালতে ১৬৪ ধারায় জিজ্ঞাসাবাদে এ তথ্য বেরিয়ে আসে।

ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় এ পর্যন্ত ১৪ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তেজগাঁও বিভাগ। চক্রের আরও দুই সদস্য রাশেদ আহমেদ বাবলু এবং মোবিন উদ্দিনও রয়েছে গোয়েন্দা জালে।

গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- মোক্তারুজ্জামান রয়েল, শামসুল হক শ্যামল, জানে আলম মিলন, মোস্তাফিজুর রহমান মিলন ও রাইসুল ইসলাম স্বপন। পরদিন সোহেল রানা, এমদাদুল হক খোকন ও এবিএম জাহিদ নামে আরও তিন জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

একই সময়ে ব্যাংকে নিয়োগের প্রশ্নপত্র তৈরির দায়িত্ব পাওয়া আহছান উল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন কর্মচারী দেলোয়ার, পারভেজ ও রবিউল এবং পরে তাদের তথ্যে জাহিদসহ আরও দু’জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে পাঁচজনই রাষ্ট্রায়ত্ব বিভিন্ন ব্যাংকে কর্মরত ছিলেন।

ডিবির তেজগাঁও জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার শাহাদাত হোসেন সুমা গণমাধ্যমকে বলেন, গ্রেপ্তার মিজানের বাড়ি রংপুরের আলমনগরের মহাদেবপুর এলাকায়। নিজেকে শেয়ার ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দেন। প্রকৃতপক্ষে সে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে অর্থ হাতিয়ে আসছিল।

নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক শর্তে ডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, পাঁচ ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন রাশেদ আহমেদ বাবুল ও মোবিনের কাছ থেকে ৩৫ লাখ টাকায় কেনে মিজান। পরে সেই প্রশ্ন জাহাঙ্গীর আলম জাহিদের কাছে ১ কোটি ২০ লাখ টাকায় বিক্রির কথা ছিল। জিজ্ঞাসাবাদ ও আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে মিজান জানিয়েছে, জাহিদ তার কাছ থেকে প্রশ্ন কিনে জনতা ব্যাংক কর্মকর্তা সোহেল রানার কাছে ২ কোটি ৮০ লাখ টাকায় বিক্রির জন্য চুক্তি করেছিল।

এর আগে আহছান উল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী দেলোয়ার জবানবন্দিতে জানিয়েছেন, প্রতি প্রশ্নপত্র সরবরাহের জন্য তিনি ৫০ হাজার টাকা পেতেন। আর প্রেস কর্মচারী রবিউল পেত ১ লাখ। শেষ পর্যন্ত সেই প্রশ্ন ২ কোটি ৮০ লাখ টাকায় বিক্রি হয় সোহেল রানার কাছে। সে আবার ১৭৫ জন ক্রেতা টার্গেট করেছিল, তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে গড়ে ১০ লাখ টাকা করে নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল।

প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত থাকা কয়েক জনকে গ্রেপ্তারের পর গত ১০ নভেম্বর রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সেই সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ডিবিপ্রধান এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেছিলেন, দীর্ঘদিন ধরে পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসরোধে কাজ করতে থাকা ডিবির তেজগাঁও বিভাগের তেজগাঁও জোনাল টিমের কাছে গত ৫ নভেম্বর রাতে এই পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস হবে- এমন তথ্য আসে। এরপর ডিবির টিম ছদ্মবেশে পরীক্ষার্থী সেজে পরীক্ষার দিন (৬ নভেম্বর) সকাল ৭টায় প্রশ্নপত্রসহ উত্তর পাওয়ার জন্য চক্রের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। চক্রটিকে অগ্রিম টাকা দেওয়া হলে ওই চক্রের অন্যতম হোতা রাইসুল ইসলাম স্বপন (৩৬) পরীক্ষার্থীকে সঙ্গে নিয়ে যান। এরপর পরীক্ষার উত্তরপত্রসহ স্বপনকে হাতেনাতে আটক করা হয়।

গত ৬ নভেম্বর পরীক্ষায় আসা প্রশ্নের সঙ্গে সকালে পাওয়া প্রশ্ন ও উত্তর হুবহু মিলে যায়। এরপর স্বপনের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রূপালী ব্যাংকের সাভার শাখার শ্রীনগর থেকে জানে আলম মিলনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

প্রশ্নপত্র ফাঁস সম্পর্কে হাফিজ আক্তার বলেন, পরীক্ষার আগে চক্রের সদস্যরা রাজধানীর বাড্ডা, বসুন্ধরা, উত্তরা, মোহাম্মদপুর, কল্যাণপুর, রূপনগর, মিরপুর, মাতুয়াইল, শেওড়াপাড়া, শেরেবাংলানগর, পল্লবী এলাকায় বুথ বসায়। ওইসব জায়গায় পরীক্ষার ৫-৬ ঘণ্টা আগে নিজস্ব লোকের মাধ্যমে পরীক্ষার্থীদের ফাঁস করা প্রশ্ন ও উত্তরপত্র মুখস্থ করানো হয়। চক্রের সদস্যদের তত্ত্বাবধানে প্রত্যেক বুথে ২০-৩০ জন পরীক্ষার্থীর ওই পরীক্ষার প্রশ্ন ও উত্তর মুখস্থ করিয়ে কেন্দ্রে পাঠান।