ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),রাজধানীর মোহাম্মদপুর প্রতিনিধি,সোমবার ২৮ জুলাই ২০২৫ || শ্রাবণ ১৩ ১৪৩২ :
রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানার কতিপয় পুলিশ সদস্য সাদ্দাম ওরফে ম্যানেজার সাদ্দাম নামে এক মাদক কারবারির কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতে হেরোইন মামলার ভুয়া এফআইআর তৈরি করে। তাতে ১০০ গ্রাম হেরোইন উদ্ধারের গল্পও সৃজন করে। এরপর গ্রেপ্তার ওই মাদক কারবারির সঙ্গে মোটা টাকায় দফারফা হয়। পরে তাকে অন্য একটি ওয়ারেন্টে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে চালান করা হয়। চাঞ্চল্যকর এ কাণ্ড ডিএমপি সদর দপ্তরের কর্মকর্তাদের নজরে আসার পর তাদের তদন্তেই বেরিয়ে আসছে ওই থানার কতিপয় পুলিশ সদস্যের অনৈতিক নানা কর্মকাণ্ডের গল্প।
Advertisement
সর্বশেষ অভিযোগ তদন্তে ডিএমপি সদর দপ্তরে ডাকা হয়েছে কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে। তাদের মধ্যে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দপ্তরে লিখিত সাক্ষী দেওয়া এক এসআই জানিয়েছেন, হেরোইন মামলা দায়ের কিংবা একই নম্বরে আরেকটি মামলা দায়েরের কোনো প্রক্রিয়াতেই তিনি জড়িত নন। উদ্দেশ্যমূলকভাবে তাকে না জানিয়েই বানানো হয়েছে মাদক মামলার বাদী। তিনি জানান, দ্ইু মামলার বিষয়ে সব জানেন মোহাম্মদপুর থানার ওসি আলী ইফতেখার হাসান ও এসআই আলতাফ হোসেন। নকল এফআইআর ড্রাফটে মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিযুক্তকারী কর্মকর্তা এসআই রাজু আহমেদ জানান, তিনিও এ মামলার বিষয়ে অবগত নন। সাজানো মামলার নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, জেনেভা ক্যাম্প বাজারস্থ ডি-ব্লকের ৭ নম্বর সেক্টর থেকে গত ৬ মে রাত ১১টা ৪০ মিনিটে ১০ লাখ টাকা মূল্যের হেরোইনসহ সাদ্দামকে গ্রেপ্তার করে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ। রাত ১২টার পর এসআই মো. শাখাওয়াত হোসেন বাদী হয়ে ওই আসামির বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা (নং-২৪/৪৪৩, তারিখ : ৭ মে) করেন।
ধারাসহ অপরাধ এবং লুণ্ঠিত দ্রব্যাদির সংক্ষিপ্ত বিবরণের ঘরে উল্লেখ করা হয়েছে- ‘অবৈধ মাদকদ্রব্য লুজ হেরোইন বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে দখলে রাখার অপরাধ; উদ্ধার- ১০০ গ্রাম লুজ হেরোইন। বিলম্বে তথ্য রেকর্ড করার কৈফিয়তের কলামে লেখা রয়েছে- বাদীর কম্পিউটার টাইপকৃত স্বাক্ষরিত এজাহার, জব্দ তালিকা, আসামি ও আলামতসহ থানায় প্রাপ্ত হইয়া এফআইআরের সব কলাম পূরণ পূর্র্বক অত্র মামলা রুজু করিলাম। প্রাথমিক তথ্য বিবরণীতে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা করা হয় এসআই রাজুু আহমেদকে। পরদিন আসামিদের চালান/২৫ বইতে ছয় আসামির মধ্যে তিন নম্বরে রয়েছে সাদ্দামের নাম। কিন্তু রহস্যজনক কারণে অন্য আসামির নাম অক্ষত থাকলেও সাদ্দামের নাম কাটা। আর একই নম্বরে দায়ের করা দ্বিতীয় মামলার (ছিনতাই) এজাহারে বাদি (এসআই ফেরদৌস জামান) উল্লেখ করেন- সেনাবাহিনীর টহল দলের সংবাদের ভিত্তিতে গত ৬ মে রাত সাড়ে ১১টার দিকে ঢাকা উদ্যান এলাকার এ-ব্লকের ২ নম্বর সড়কে অভিযানে যান এসআই ফেরদৌস। এ সময় ছিনতাইয়ের অভিযোগে মো. মামুন হোসেন নামে এক যুবককে সামুরাইসহ গ্রেপ্তার করা গেলেও পালিয়ে যায় তার দুই সহযোগী। এই ঘটনায় গত ২৯ মে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা।
Advertisement
গ্রেপ্তার সাদ্দামের বসবাস জেনেভা ক্যাম্পে। সেখানে কথা হয় তার বোন রীনা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমার ভাই আগে মাদকের সঙ্গে জড়িত থাকলেও বর্তমানে সব ছেড়ে দিয়েছে। কোনো মাদক উদ্ধার নয়, মারধরের হাত থেকে আমার ভাইকে সেদিন বাঁচিয়ে নিয়ে যায় থানায় পুলিশ। এরপর আদালতে চালান করে। এ ঘটনায় হেনস্তার শিকার হচ্ছেন বলেও জানান তিনি।
হেরোইনের মামলার এফআইআরে উল্লেখিত বাদী মোহাম্মদপুর থানার এসআই মো. শাখাওয়াত হোসেনও বলেন, জেনেভা ক্যাম্প থেকে হেরোইনসহ সেদিন কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। এই ঘটনায় মাদক ব্যবসায়ীকে পেয়েও মামলা না দেওয়ার বিষয়ে ডিএমপি সদরদপ্তরে অভিযোগ জমা পড়েছে। আমি লিখিত স্বাক্ষি দিয়ে এসেছি ডিসি অফিসে। আমি এ মামলার বাদী হইনি, এজাহার এফআইআরসহ কোনো কিছুই আমি তৈরি করিনি; কোথাও আমার স্বাক্ষরও নেই। যা থানার সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ দেখলেই বোঝা যাবে। এরপরও কেন আমাকে বাদী বানানো হলো বুঝতে পারছি না!
তিনি বলেন, সেদিন রাতে এসআই আলতাফ স্যারের নেতৃত্বে আমরা প্যাট্রল ডিউটিতে ছিলাম। হঠাৎ খবর আসে ক্যাম্পে মারামারি হচ্ছে। খবর পেয়ে সেখানে গিয়ে দেখি সাদ্দামকে মারধর করে আটকে রাখা হয়েছে। আলতাফ স্যারের নির্দেশে সাদ্দামকে থানায় আনি; পরদিন সাবেক একটি মাদক (৭ মে) মামলার ওয়ারেন্টে তাকে চালান করি। সে রাতে তার সঙ্গে কোনো মাদক পাওয়া যায়নি, তাই তার বিরুদ্ধে মাদকের মামলা হয়নি। এফআইআর থেকে সাজানো সব কিছুই হয়তো আলতাফ স্যার করেছেন। ডিএমপি সদরদপ্তরে এ বিষয়ে তাকে ডাকা হয়েছে। তিনি বলেন, আমার সরলতার সুযোগ নিয়ে সবকিছু তৈরি করে জিজ্ঞাসা না করেই আমার নাম বাদী হিসেবে এফআইআরে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। পুরো বিষয়টি অবগত আছেন ওসি স্যার। কারণ, ওই এফআইআর ফরম তৈরি করার ক্ষমতা ওসি স্যারের। ওসি স্যার ও আলতাফ স্যারকে জিজ্ঞাসা করলেই পুরো বিষয়টি ক্লিয়ার হয়ে যাবে। সাক্ষী দেওয়ার সময় আমি মোহাম্মদপুর থানায় ছিলাম, এক মাস আগে আমাকে বরিশালে বদলি করা হয়।
সাদ্দামের বোন, এফআইআরে সাজানো বাদী (এসআই শাখাওয়াত) এবং তদন্তকারী কর্মকর্তার (এসআই রাজু) বক্তব্য অনুয়ায়ী প্রশ্ন উঠেছে, সেদিন রাতে মাদকসহ সাদ্দামকে গ্রেপ্তার করা না হলেও কেন তার বিরুদ্ধে ১০০ গ্রাম হেরোইন উদ্ধারের মিথ্যা নাটক সাজানো হলো?
আমাদের সময়ের অনুসন্ধান এবং পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ভাষ্যে উঠে এসেছে, গ্রেপ্তার সাদ্দাম সংঘবদ্ধ মাদক কারবারি চক্রের সক্রিয় সদস্য। বিভিন্ন সময়ে মাদক নিয়ে ধরাও পড়েছে। দেনা-পাওনা দ্বন্দ্বের জেরে গত ৬ মে দিনগত রাতে সাদ্দামকে বাসার সামনেই বেধড়ক পেটায় প্রতিপক্ষ। খবর পেয়ে পুলিশ মারধরের হাত থেকে বাঁচাতে সাদ্দামকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। এরপর আহত সাদ্দামকে বিভিন্ন মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে প্রথমে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করা হয়। টাকা না দিলে পুলিশের পুরনো ফরমেটে এফআইআর তৈরি করে তাতে সাদ্দামকে আসামি করে ১০০ গ্রাম হেরোইন উদ্ধারের নাটক সাজানো হয়। দেনদরবারে দফারফা হলে মামলার এফআইআর কপি গায়েব করে সাদ্দামকে ২০২৪ সালের একটি মাদক মামলার ওয়ারেন্টে আদালতে চালান দেওয়া হয়।
এ অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে এসআই আলতাফ হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, সাদ্দামের বিরুদ্ধে ৩০ গ্রাম হেরোইনসহ গ্রেপ্তার ও বিস্ফোরক আইনে পূর্বের দুটি মামলার ওয়ারেন্ট ছিল। ওই দুটি ওয়ারেন্টে গ্রেপ্তার দেখিয়ে পরদিন তাকে আদালতে চালান দিই। সেদিন সাদ্দামের কাছ থেকে কোনো মাদক উদ্ধার না হওয়ায় তার বিরুদ্ধে এ সংক্রান্ত কোনো মামলা হয়নি। লেনদেনের অভিযোগ উদ্দেশ্যমূলক। এ ছাড়া ওই এফআইআর কীভাবে তৈরি হলো, তা বুঝতে পারছি না।
কোনো অভিযোগ না থাকলে ডিএমপি সদর দপ্তরে কেন ডাকা হয়েছিল? এমন প্রশ্নে আলতাফ হোসেন বলেন, সাদ্দামকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে নয়, অন্য একটি বিষয়ে সাদ্দামের স্ত্রী ও আমাকে ডাকা হয়েছিল।
Advertisement
https://www.youtube.com/live/E9fMBkbJ3-M?si=k2Ro-HFkcInWkNQ
অভিযোগের বিষয়ে জানতে মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলী ইফতেখার হাসানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সাড়া দেননি। হোয়াটসঅ্যাপে দুই মামলার এফআইআর কপি পাঠিয়ে বিস্তারিত জানতে চাওয়া হলেও উত্তর মেলেনি।
তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মো. জুয়েল রানা জানান, অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ঘটনার সত্যতা পেলে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
