সাংবাদিক আশফাকের বাসার গৃহকর্মীরা কেন বার বার আত্মহত্যা

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),ঢাকা প্রতিনিধি,সোমবার, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ : ছয় মাস আগেও সাত বছরের এক শিশু গৃহকর্মী বাসা থেকে লাফ দিয়েছিল। রক্তাক্ত জখম হলেও সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় ফেরদৌসি নামের সেই শিশুটি। সে ঘটনায় মামলাও হয়েছিল। ছয় মাস পেরোতে না পেরোতেই আবারও এক শিশু গৃহকর্মী একই বাসা থেকে লাফ দেয়। এবার আর ভাগ্য সহায় হয়নি। আট তলা থেকে লাফ দিয়ে এক তলার গ্যারেজের ছাদের ওপর পড়ে ১৫ বছর বয়সী প্রীতি উড়ান। হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

Advertisement

ছয় মাসের ব্যবধানে পরপর দুই শিশু গৃহকর্মীর সঙ্গে একই ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক আশফাকুল হকের বাসার ভেতরে কী এমন ঘটনার অবতারণা হয় যে শিশু গৃহকর্মীরা আট তলা থেকে লাফ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছে? বাসায় কি তাদের শারীরিক, মানসিক কিংবা যৌন নির্যাতন করা হয়? নাকি শিশুদের ফেলে দেওয়া হচ্ছে?

 

অবশ্য প্রীতি উড়ানের বাবার অভিযোগ, অভাবের কারণে দুই বছর আগে মিন্টু নামে স্থানীয় এক ব্যক্তির মাধ্যমে সাংবাদিক আশফাকুল হকের বাসায় ছোট মেয়েকে গৃহকর্মীর কাজে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু আশফাকুল হকের পরিবার দুই বছরেও মেয়েকে তাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতে দেয়নি। মাসে দুই-একবার গৃহকর্তার মোবাইলে যোগাযোগ করে কথা বলিয়ে দিতো তারা।

Advertisement

মঙ্গলবার (৬ ফেব্রুয়ারি) সকালে মোহাম্মদপুরের শাজাহান রোডের ওই বাসার নিচতলার গ্যারেজের ওপর থেকে রক্তাক্ত অবস্থায় প্রীতি উড়ানকে উদ্ধার করে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে যান বাসার কেয়ারটেকার। হাসপাতালে নেওয়ার আগেই তার মৃত্যু হয় বলে জানিয়েছেন কর্তব্যরত চিকিৎসক। ওই ভবনের অষ্টম তলার একটি ফ্ল্যাটে সৈয়দ আশফাকুল হকের বাসা।

Advertisement

এই ঘটনায় নিহত প্রীতি উড়ানের বাবা লুকেশ ওড়ান বাদী হয়ে মোহাম্মদপুর থানায় একটি মামলা (নম্বর ৩৭) দায়ের করেছেন। মামলায় সৈয়দ আশফাকুল হক ও তার স্ত্রী তানিয়া খন্দকারকে আসামি করা হয়েছে। বুধবার (৭ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে তাদের আদালতে সোপর্দ করে পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়। আদালত শুনানি শেষে আশফাকুল হক ও তানিয়াকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন।

 

প্রীতিকে হত্যা করা হয়েছে, দাবি পরিবারের

প্রীতিরপরিবারওস্বজনদেরঅভিযোগ, তাকেহত্যাকরাহয়েছে।তারাএরবিচারচান।প্রীতিরমানমিতাউরাংবলেন, ‘দুইবছরআগেডেইলিস্টারেরমৌলভীবাজারপ্রতিনিধিমিন্টুদেশোয়ারা১৫বছরবয়সিপ্রীতিকেদেখেতারবাবারসঙ্গেকথাবলেন।প্রীতিকেঢাকায়একটিভালোচাকরিদেওয়ারপ্রস্তাবকরেনমিন্টু।প্রীতিরমা-বাবাসেইপ্রস্তাবেরাজিহন।পরিবারেরসচ্ছলতাআনতেমিন্টুরমাধ্যমেঢাকাপাঠানোহয়প্রীতিকে।

 

নমিতা জানান, ভালো কাজের কথা বলে তাকে ঢাকায় নিয়ে দেওয়া হয় গৃহকর্মীর কাজ। ঢাকার মোহাম্মদপুরে দ্য ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল হকের বাসার গৃহকর্মী হয় প্রীতি। চা-বাগানের বাইরে চা-শ্রমিকদের আর্থ-সামাজিক সম্পর্ক না থাকায় ভালো কিছুর আশায় পরিবারটি সহজে রাজি হয়ে যায়। গত দুই বছরে তার পরিবারকে পারিশ্রমিক হিসেবে ১৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়।

Advertisement

প্রীতির বাবা লোকেশ উরাং বলেন, ‘গত ৬ ফেব্রুয়ারি সকালে হঠাৎ করে সাংবাদিক মিন্টু আমাদের শ্রীমঙ্গলে একটি মিটিংয়ে নিয়ে যাবেন বলে জানান। শ্রীমঙ্গল যাওয়ার পর অন্য একটি গাড়িতে করে আমাদের মিন্টু ঢাকায় নিয়ে যান প্রীতি অসুস্থ বলে। কিন্তু গিয়ে দেখি আমাদের মেয়েটি আর নেই।’

 

প্রীতিকে হত্যা করা হয়েছে দাবি করে এর বিচার চেয়েছে পরিবার ও এলাকাবাসী। এ উপলক্ষে শনিবার সকালে মিরতিংগা চা-বাগানে শ্রমিক ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ব্যানারে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়। মানববন্ধন কর্মসূচিতে বক্তব্য দেন রহিমপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ইফতেখার আহমেদ বদরুল, মিরতিংগা চা-বাগান পঞ্চায়েত সভাপতি মন্টু অলমিক প্রমুখ। মানববন্ধনে বক্তারা ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে বিচারের দাবি জানান। মানববন্ধনে চা-বাগানের শ্রমিকসহ স্থানীয় লোকজন ও জনপ্রতিনিধিরা অংশ নেন।

শারীরিক-মানসিক নির্যাতন?

সাংবাদিক আশফাকুল হকের বাসায় পরপর একই ধরনের দুটি ঘটনা ঘটার পর প্রশ্ন উঠেছে, বাসায় গৃহকর্মীদের শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করা হতো কি না? তা না হলে ছয় মাসের ব্যবধানে দুই শিশু গৃহকর্মী জানালা দিয়ে লাফ দেওয়া বা পালানোর চেষ্টা করবে কেন? আর সৈয়দ আশফাকুল হকের মতো  ‘সমাজসচেতন’ ব্যক্তি কেন একটি ঘটনার পর সতর্ক হলেন না?

 

মামলার এজাহারে অবশ্য নিহত প্রীতির বাবা অভিযোগ করেছেন, গত দুই বছর ধরে প্রীতিকে তাদের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। মাসে একবার-দুবার গৃহকর্তার মোবাইল ফোনে মেয়ের সঙ্গে কথা বলতেন।

তদন্তের সঙ্গে যুক্ত একজন কর্মকর্তা বলেন, বারবার একই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার কথা নয়। ওই বাসায় কেউ না কেউ গৃহকর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার বা শারীরিক- মানসিক নির্যাতন করতেন বলে তারা ধারণা করছেন। একারণে গৃহকর্মীরা বাসায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন না। বাসা থেকে পালাতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। এছাড়া কেউ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে কি না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

 

মোহাম্মদপুর থানার ওসি মাহফুজুল হক ভুঁইয়া বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সৈয়দ আশফাকুল হক ও তার স্ত্রী তানিয়া খন্দকার গৃহকর্মীর নিচে পড়া সম্পর্কে কিছু জানেন না বলে দাবি করেছেন। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটন করার চেষ্টা চলছে।

Advertisement

আগের মামলায় বাদীর সঙ্গে আপস

ছয় মাস আগে একই বাসা থেকে ফেরদৌসি পড়ে আহত হওয়ার ঘটনায় শিশুটির মা জোছনা বেগম মোহাম্মদপুর থানায় একটি মামলা দায়ের করেছিলেন। ওই মামলাতেও সৈয়দ আশফাকুল হক, তার স্ত্রী তানিয়া খন্দকার ও আসমা আক্তার শিল্পী নামে এক নারীকে আসামি করা হয়েছিল। আসমা আক্তার ওই শিশুকে সৈয়দ আশফাকুল হকের বাসায় কাজে নিয়োজিত করার মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছিল।

 

সেসময় পুলিশ সূত্র জানায়, শিশুটি বাসায় কাজ করতে না চাইলেও তাকে বাসায় আটকে রেখে কাজ করানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু শিশুটি ড্রয়িং রুমের থাই গ্লাস খুলে পালিয়ে যাওয়ার জন্য লাফিয়ে পড়ে। ওই ঘটনায় শিশু আইনের ৭০ ধারায় শিশুকে হেফাজতে রেখে ব্যক্তিগত কাজে নিয়োজিত করে নির্যাতন ও অবহেলায় সংগঠিত শিশুর শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষতির ঘটনায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল।