ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),নরসিংদী প্রতিনিধি,রোববার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২১ : ২৬ এপ্রিল ২০২০। নরসিংদী মডেল থানার সাতপাড়া গ্রাসের পূর্বপাশে মেঘনার শাখা নদীতে ভেসে ওঠে এক অজ্ঞাতপরিচয় নারীর মরদেহ। তখন বেলা ২টা।
এক প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, লাশটি রোরকা পরানো অবস্থায় ভাসানো ছিল।
এ ঘটনায় নৌ পুলিশ অপমৃত্যু মামলা করে। সুরতহাল ও পোস্টমর্টেমের পর অজ্ঞাত লাশ হিসেবে দাফন করে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম। ফেসবুকে ছবি ও কাপড়চোপড় দেখে রায়পুরা থানার চরমধুয়া গ্রামের কোহিনুর বেগম নিশ্চিত করেন অজ্ঞাতপরিচয় মরদেহটি তার মেয়ে লিপার।
কে বা কারা হত্যা করল লিপাকে? কীভাবে হলো রহস্য উদঘাটন? সময়ের অসঙ্গতির এবারের পর্বে থাকছে তার আদ্যোপান্ত।
নরসিংদী জেলার চরমধুয়া গ্রামের খলিল মিয়া ও কোহিনুর বেগমের মেয়ে লিপা। একই গ্রামের যুবক আমিনুলের নজরে পরে লিপা।
এ বাস্তবতায় বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে ছেলে দেখা শুরু করে লিপার পরিবার। কাকতালীয়ভাবে, যে যুবকের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য লিপার বিয়ের তোড়জোড় চলছে সেই আমিনুলের বাবাই একটি সম্বন্ধ নিয়ে আসেন। এবং ঘটনাচক্রে আমিনুলের বাবার ঘটকালিতেই রায়পুরা থানার বাঁশগাড়িতে বিয়ে হয় লিপার।
বাঁশগাড়ির ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আব্দুল সালাম শিকদার বলেন, আমি শুনেছি বিয়ে হয়েছে। ওই ঘরে একটা বাচ্চাও আছে। পরে নাকি তাকে নিতে চাচ্ছে না এটা শুনেছি।
বিয়ের এক বছরের মাথায় লিপার কুল জুড়ে আসে একটি ছেলে সন্তান। কিন্তু তারপরও আমিনুল লিপার পিছু ছাড়েনি। আমিনুল লিপার স্বামীকে বিয়ের আগের প্রেমের সম্পর্কের কথা বলে খেপিয়ে তোলে। সদ্যজাত ছেলেটি তার নয় এমন অপবাদ দিয়ে সন্তানসহ লিপাকে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দেয় তার স্বামী। স্বামী আরেকটি বিয়ে করে লিপা ও তার ছেলের কথা বেমালুম ভুলে যায়।
লিপার মা কোহিনুর বেগম বলেন, আমার মেয়ে একটা ছেলে হওয়ার পর মেয়ের স্বামীর কোনো খোঁজখবর নেই। এ সুযোগে আমিনুল আবার লিপার সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।
এ সুযোগে আমিনুল আবার লিপার সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে। এক পর্যায়ে লিপা গর্ভবতী হয়ে পড়ে। বাচ্চা নষ্ট করার জন্য আমিনুল লিপাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। ডাক্তার জানায় বাচ্চা নষ্ট করা যাবে না। তখন লিপা, বিয়ের জন্য চাপ দেয় আমিনুলকে।
আগে পরে কখনোই প্রেম কিংবা বিয়ে কোনোটাই উদ্দেশ্য ছিল না আমিনুলের। তার মতলব ছিল প্রতারণার। এবার ফেঁসে যাওয়ার ভয়ে লিপাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে আমিনুল।
২৪ এপ্রিল ২০২০। লিপা তার মাকে জানায় আমিনুল তাকে মেনে নেবে। তারা পালিয়ে বিয়ে করতে যাচ্ছে।
লিপার দাদী নূর জাহান বলেন, সেদিন মাগরিবের আজানের পর সেজে-গুজে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় লিপা।
তার দু’দিন পর মেঘনার শাখা নদীতে মেলে লিপার মরদেহ। বিয়ের কথা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া লিপা কীভাবে খুন হলো? তার উত্তর পাওয়া গেছে। তবে, তার জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে পিবিআইকে। আর লিপার মাকে উপেক্ষা করতে হয়েছে হত্যা থেকে শুরু করে নানা ধরনের নানা ধরনের হুমকি ধামকি।
লিপার মা জানান, মরদেহ শনাক্ত করার জন্য যখন তিনি মর্গে তখন তার সাথেই ছিলেন, তার মেয়েকে হত্যার ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণকারী একজন।
লিপার মা যেন কোনোভাবেই মামলা করতে না পারে সেজন্য তৎপর হয়ে ওঠে আমিনুলের পরিবার। ভয়ভীতি ও প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে নরসিংদী আদালতে অভিযোগ দায়ের করেন লিপার মা। কোর্ট নরসিংদী সদর থানাকে এফআইআর গ্রহণের নির্দেশ দিলে মামলা রুজু হয়। প্রথমে নৌ-পুলিশকে তদন্ত দেওয়া হলেও কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় লিপার মা কোহিনুরের অনুরোধে পিবিআই নরসিংদী মামলাটি অধিগ্রহণ করে।
তদন্তের শুরুতেই আমিনুল ও তার পরিবারকেই সন্দেহ হয় পিবিআইয়ের।
নরসিংদী পিবিআই’র পুলিশ পরিদর্শক জামাল উদ্দিন খান বলেন, নির্দিষ্ট কোনো আঘাত না থাকায় একটি অপমৃত্যু মামলা করা হয়। পরে ময়নাতদন্তে দেখা যায় লিপাকে হত্যা করা হয়। এতে লিপার মাকে বিভিন্ন ধরনের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। তাকে এলাকায় থাকতে দেবে না। লিপার পরিবারের লোকজন অত্যন্ত গরিব। আর যারা খুন করেছেন তারা অত্যন্ত প্রভাবশালী।
নরসিংদী পিবিআই’র পুলিশ সুপার এনায়েত হোসেন মান্নান বলেন, আমরা আমিনুলকে সন্দেহের জন্য অনেক কারণ রয়েছে। বিয়ের আগ থেকে তাদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল; এছাড়া লিপার যে বিয়ে হয়েছে সেখানে আমিনুলের বাবা ঘটকালিতে ছিল। এবং ওইটা একটা কৌশল।
১ জুন ২০২০। নারায়ণগঞ্জ, ডেমরা ও বাংলামটর এলাকায় পরপর তিনটি অভিযানের পর লিপা হত্যা মামলার প্রথম কোনো আসামিকে বাগে পায় পিবিআই। তিনি জহিরুল আমিনুলের চাচাতো ভাই।
চাচাতো ভাই জহিরুল আদালতে জবানবন্দিতে লিপাকে কীভাবে হত্যা করা হয় তার বিস্তারিত জানায়। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জহিরুল জানায় লিপাকে হত্যা করতে চারজন করে দুই টিমে মোট আটজন ছিলো।
জহিরুল জানান, ঘটনার ৪-৫ দিন আগে লিপাকে হত্যার পরিকল্পনার কথা জানায় মমিনুল। জহিরুল রাজি না হলে আমিনুল এতে বংশের বড়দের সম্মতি আছে।
পিবিআই- বংশের মর্যাদা রক্ষা করতে হত্যার সিদ্ধান্ত
জহিরুল জানান, তিনি প্রথমে আমিরুলের বাড়ির কাছে যান। সেখানে সুজন ও আতিক ছিল। আমিনুল একটি কোদাল দিয়ে সুজন ও আতিকে বাজারে পাঠায় নৌকা আনতে। আমিনুল জহিরুলকে নিয়ে মেঘনার শাখা নদীর পাড়ে যায়। কিছুক্ষণ পর লিপাকে নিয়ে সেখানে আসে সেলিম, নুরুল ও খায়রুল। সুজন ও আতিক নৌকা নিয়ে আসে। লিপাকে নিয়ে সেই নৌকায় ওঠে আমিনুল। সাথে ছিলো জহিরুল, আতিক ও সুজন। নৌকা মাঝ নদীতে গেলে গামছা নিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয় লিপাকে। চরে মরদেহ পুতে ফেলার পরিকল্পনা থাকলেও মাছ মারতে আসা জেলেদের কারণে তা আর সম্ভব হয়নি।
পিবিআই জানায়, লিপাকে আমিনুল বলেন বিয়ে করবে। অন্যদিকে সুজনসহ অন্যদের জানান, আজকে লিপার শেষদিন এভাবে তারা পরিকল্পনাটি করেন। এবং লাশ পুঁতে রাখার জন্য কোদাল, খুন্তি, খাঁচা ইত্যাদি সরঞ্জাম নিয়ে আসেন।
হত্যার পর লিপার মোবাইল ও ব্যাগ মেঘনা নদীতে ফেলে দিয়ে আসামিরা যার যার বাড়িতে চলে যায়।
ইউনিয়ন চেয়ারম্যান জানান, লিপাকে হত্যার পর যখন পূর্বপরিকল্পনা মতো চরে পুঁতে ফেলা সম্ভব হচ্ছিল না। তখন স্থানীয় এক মেম্বার নদীতে মরদেহ ফেলে দেওয়ার পরামর্শ দেন।
চরমধুয়া দড়িহাটি মাজার। ঢাকা থেকে একটি এনজিওর কর্মকর্তারা এসেছেন মাজার উন্নয়নের জন্য তথ্য নিতে। এনজিও কর্মীরা এক পর্যায়ে গ্রামের এক যুবককে অপহরণ করে নরসিংদী নিয়ে যায়। সাধারণ লোকের চোখে ঘটনাটি এমন মনে হলেও ঘটনাটি ছিল ভিন্ন। সেদিন আসলে লিপা হত্যা মামলায় অন্যতম আসামি আমিনুলের ভাই সেলিমকে গ্রেপ্তার করা হয়। আর এনজিও কর্মকর্তাদের ছদ্মবেশে ছিলে পিবিআইএয়ের আভিযানিক দল।
সেলিমের মতো যে নৌকায় লিপাকে হত্যা করা হয় সেই নৌকার মালিক সুজনকে গ্রেপ্তারের ঘটনাটিও নাটকীয়।
অপরাধের আলামত মুছে ফেলতে, আসামিরা হত্যায় ব্যবহৃত গামছা, কোদাল, কাপড় ও মোবাইল মেঘনা নদীতে ফেলে দেয়। এমনকি বিক্রি করা হয় নৌকাটিও। তবে সুজনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী জব্দ করা হয় নৌকাটি।
নরসিংদী পিবিআই’র পুলিশ সুপার এনায়েত হোসেন মান্নান বলেন, মামলার আলামতগুলো তারা নষ্ট করার চেষ্টা করে, গামছা, কোদালসহ ইত্যাদি সরঞ্জামগুলো তারা ফেলে দিয়েছে। এবং তারা নৌকাটি গায়েব করার চেষ্টা করেছে। তবে সুজনের তথ্য মতে আমরা নৌকাটি উদ্ধার করি।
মূল আসামি আমিনুলকে এখনও গ্রেপ্তার করতে পারেনি পিবিআই। গ্রামে রটনা রয়েছে যে আমিনুল এরইমধ্যে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে।
আমিনুলের মা সখীনা বেগম বলেন, আমিনুল কোথায় আছে আমি বলতে পারবো না। আজকে তিনমাস ধরে ওর কোনো খোঁজ নেই।
তবে, পিবিআই মনে করে গ্রেপ্তার থেকে বাঁচতে বিদেশে যাওয়ার তথ্যটি আমিনুলই কৌশলে ছড়াতে পারে।
মেয়ের হত্যার বিচার চেয়ে এখনও গ্রাম ছাড়া লিপার মা। আর মামলা তুলে নিতে প্রতিনিয়ত চাপ-তো আছেই।
লিপার মা কোহিনুর বেগম বলেন, আমি বিচার চাই। কোনো আপস করবো না। তারা বলে, মশা মেরে ফেলেছি, কী করতে পারবে? আমাকে গালিগালাজ করেছে।
পিবিআই চার্জশিট দিলেই শুরু হবে, লিপা হত্যা মামলার বিচার প্রক্রিয়া। কিন্তু মা কোহিনুর বেগম যদি মেয়ে হত্যার বিচার চেয়ে জেদ না ধরতেন আর তার পাশে পিবিআই না দাঁড়াতো তাহলে লিপার ভাগ্যে আসলে কী ঘটেছে সেটা অজানাই থেকে যেত।