ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম,খুলনা-১ প্রতিনিধি,শুক্রবার ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫ || অগ্রহায়ণ ২০ ১৪৩২ :
বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ভিন্নধর্মের মানুষকে জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী করার ঘোষণা দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। হিন্দু-অধ্যুষিত খুলনা-১ (দাকোপ-বটিয়াঘাটা) আসনে দলটির প্রার্থী হচ্ছেন কৃষ্ণ নন্দী। তিনি ডুমুরিয়া উপজেলা জামায়াতের হিন্দু কমিটির সভাপতি। এই আসনে মাওলানা আবু ইউসুফকে আগে প্রার্থী ঘোষণা করা হলেও নন্দীকে নিয়ে গুঞ্জন ছিল। এবার সেটা সত্যি হলো।
Advertisement
গত সোমবার (১ ডিসেম্বর) খুলনায় আট দলের বিভাগীয় সমাবেশে এসে জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান এ সিদ্ধান্ত দেন। এরপর আজ বুধবার বিকেলে স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে জেলা জামায়াতের আমির মাওলানা এমরান হোসাইন সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। এরপর কৃষ্ণ নন্দীকে নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়েছে—কে তিনি!
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খুলনার ‘ধর্মীয় সংখ্যালঘু অধ্যুষিত’ একটি আসনে হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে প্রার্থী করার বিষয়ে আলোচনা ছিল। সেখার থেকেই ব্যবসায়ী কৃষ্ণ নন্দীর নাম চর্চায় আসে। কৃষ্ণ নন্দীর প্রার্থী হওয়ার বিষয়টি খুলনার ডুমুরিয়া, দাকোপ ও বটিয়াঘাটা—এই তিন উপজেলায় রাজনৈতিক মহল ও হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এই নেতার বাড়ি ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগরে। সেখানে তাঁর একাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর আগে তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য নারায়ণ চন্দ্র চন্দের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কৃষ্ণ নন্দী ডুমুরিয়া উপজেলা জামায়াতে ইসলামী হিন্দু শাখার নেতা হন এবং সেখানে দলের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে তাঁকে দেখা গেছে।
সম্প্রতি ডুমুরিয়ায় এক সভায় কৃষ্ণ নন্দী বলেন, ‘আমি ২০০৭ সাল থেকে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। দীর্ঘ সময়ে সদস্যদের দুঃখ-কষ্টে পাশে থেকেছি। গেল আওয়ামী লীগ সরকারের দমন-পীড়নের সময়ে নেতা–কর্মীদের পাশে ছিলাম। দেড় বছর আগে ডুমুরিয়ায় দলের হিন্দু শাখার সভাপতির দায়িত্ব পাই।’
দাকোপ-বটিয়াঘাটা আসনের প্রার্থী ঘোষণা করা হলেও কৃষ্ণ নন্দীর বাড়ি ডুমুরিয়া উপজেলায়। কিন্তু ডুমুরিয়া-ফুলতলা উপজেলা নিয়ে গঠিত খুলনা-৫ আসনে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী দলের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার।
জামায়াতের নেতা–কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দলের মনোনয়ন পেতে হলে প্রার্থীকে ন্যূনতম ‘রুকন’ হতে হয়। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ইসলাম ধর্মের বাইরেও প্রার্থী দেওয়ার বিষয়টি দলের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা সদস্য ও খুলনা জেলার সেক্রেটারি মুন্সি মিজানুর রহমান মিজান সম্প্রতি গণমাধ্যমে বলেছেন, কিছু এলাকায় হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও উপজাতি প্রার্থী দেওয়ার বিষয়ে গত মাসে সিদ্ধান্ত হয়। তবে পরে দল প্রার্থী পরিবর্তন করতে পারবে।
কৃষ্ণ নন্দী ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কমকে বলেন, ‘আমাকে জামায়াতের পক্ষ থেকে চূড়ান্ত প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। ১ ডিসেম্বর আমিরে জামায়াত প্রার্থী ঘোষণা দিয়েছেন এবং বুধবার স্থানীয় বোর্ডে চূড়ান্ত হয়েছে। শিগগির প্রচারণা শুরু করব।
আগে ঘোষিত প্রার্থীর বিষয়ে কৃষ্ণ নন্দী বলেন, ‘১ ডিসেম্বর আমিরে জামায়াত আমাদের দুজনকে বুকে বুক মিলিয়ে দিয়ে গেছেন। তিনি নিজেই আমার জন্য প্রচারণায় নেমেছেন। তা ছাড়া জামায়াতের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই।’
আগের প্রার্থী মাওলানা আবু ইউসুফ বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামীর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী খুলনা-১ আসনের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রার্থী কৃষ্ণ নন্দী। তাঁর পক্ষে আমি প্রচারণা শুরু করেছি। যেহেতু আমাকেই নির্বাচন পরিচালনা কমিটির পরিচালক করা হয়েছে, সেহেতু সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমি যথাসম্ভব কাজ করব, ইনশা আল্লাহ।’
গত ৯ ফেব্রুয়ারি খুলনার ছয়টি আসনের জন্য জামায়াতের প্রার্থী ঘোষণা করা হয় আনুষ্ঠানিকভাবে। এর মধ্যে বাকি পাঁচটি আসনের প্রার্থী ঠিক থাকলেও শুধু খুলনা-১ আসনে প্রার্থী পরিবর্তন করে হিন্দু সম্প্রদায়ের কাউকে প্রার্থী করা হলো প্রায় ১০ মাসের ব্যবধানে।
হিন্দু-অধ্যুষিত এই আসনে ১৯৯৬ সালে নির্বাচন করেন জামায়াত নেতা আবু ইউসুফ। পরের পাঁচটি নির্বাচনে জামায়াত আর প্রার্থী দেয়নি। তিন দশক পর আবার সেখানে জামায়াত নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছে।
দলটির নেতা-কর্মীরা জানান, প্রথম দফায় খুলনা-৪, খুলনা-৫ ও খুলনা-৬ আসনে প্রাথমিকভাবে দলীয় প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হয়। এরপর চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি অন্য তিন আসনে প্রার্থী ঘোষণা করে দলটি। এর মধ্যে খুলনা-১ (দাকোপ-বটিয়াঘাটা) আসনে শেখ আবু ইউসুফের নাম ঘোষণা করা হয়।
ডুমুরিয়া-ফুলতলা নিয়ে গঠিত খুলনা-৫ আসনও হিন্দু-অধ্যুষিত। এক বছর ধরে ডুমুরিয়া ও ফুলতলায় জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারের বিভিন্ন রাজনৈতিক সমাবেশে কৃষ্ণ নন্দীকে দেখা গেছে। তাঁর নেতৃত্বে প্রতিটি সমাবেশেই সনাতন ধর্মাবলম্বী নারী-পুরুষদের সরব উপস্থিতি ছিল।
দাকোপ দেশের একমাত্র হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ উপজেলা। এখানে ৫৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ বাসিন্দাই হিন্দু। এ ছাড়া খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী আছে ২ দশমিক ১২ শতাংশ। অন্য ৪৩ দশমিক ৪৩ শতাংশ বাসিন্দা ইসলাম ধর্মের অনুসারী। আর বটিয়াঘাটা উপজেলার ২৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ বাসিন্দা হিন্দু ধর্মের।
এই আসনে ১৯৯১ সাল থেকে টানা জয় পেয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী। বিএনপির প্রার্থীও এখানে কখনো সুবিধা করতে পারেননি। জামায়াতের প্রার্থী শেখ আবু ইউসুফ ১৯৯৬ সালে এই আসনে পেয়েছিলেন ২ হাজার ৩০৮ ভোট, যা মোট ভোটের মাত্র ২ শতাংশ।
জামায়াতের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা হলে তাঁরা ধারণা দেন, আওয়ামী লীগের কার্যক্রম এখন নিষিদ্ধ। এ কারণে দলটির ঘাঁটিতে জয়ের সম্ভাবনা তৈরি করতে হিন্দু ধর্মের একজনকে প্রার্থী ঘোষণা করতে চায় জামায়াত।
Advertisement
প্রতিটি উপজেলায় সংবাদদাতা আবশ্যক। যোগাযোগ ০১৭১৪৪৯৭৮৮৫

খুলনা-১ আসনে ১৯৯১ সালের পর ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির ‘একতরফা’ নির্বাচন ছাড়া বিএনপি কখনো জেতেনি। এখানে সব সময় আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র হিসেবে হিন্দু ধর্মাবলম্বী প্রার্থী জিতেছেন। একসময় বামপন্থী দলের প্রভাব থাকলেও জামায়াতের অবস্থান সব সময় দুর্বল ছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে জামায়াতের সাংগঠনিক কার্যক্রম কিছুটা বেড়েছে।
এখানে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে জেলা কমিটির সাবেক আহ্বায়ক আমীর এজাজ খান প্রচার চালাচ্ছেন। তিনি ২০০১, ২০০৮ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে এখানে দলীয় প্রার্থী ছিলেন। পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রদল নেতা জিয়াউর রহমান (পাপুল), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রনেতা পার্থ দেব মণ্ডল গণসংযোগ করছেন। বাম গণতান্ত্রিক জোটের পক্ষে দাকোপ উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান কিশোর কুমার রায়ও আলোচনায় রয়েছেন।
১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এখনকার খুলনা-১ আসনটি খুলনা-৫ নামে ছিল। স্বাধীনতার পর এখানে প্রথম সংসদ সদস্য হন কুবের চন্দ্র বিশ্বাস। দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে জয় পান প্রফুল্ল কুমার শীল। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির একতরফা নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে জয়ী হন প্রফুল্ল কুমার মণ্ডল।
১৯৯৬ সালের জুনের নির্বাচনে জয়ী হন শেখ হাসিনা। পরে তিনি আসনটি ছেড়ে দিলে উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান শেখ হারুনুর রশিদ। কিন্তু স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে বিজয়ী হন পঞ্চানন বিশ্বাস। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের হয়ে আবার জয়ী হন পঞ্চানন।
Advertisement

২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হন আওয়ামী লীগের ননী গোপাল মণ্ডল। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে আবার সংসদ সদস্য হন পঞ্চানন বিশ্বাস। ২০২৪ সালে জয়ী হন ননী গোপাল মণ্ডল।

জামায়াতের আমির ও সেক্রেটারি জেনারেলের সঙ্গে কৃষ্ণ নন্দী। ছবি: সংগৃহীত


