শিক্ষক স্মৃতি: আলোকিত মানুষ মোঃ আবদুস ছোবহান

SHARE

য়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (ভিডিও),সবার দেশ পত্রিকার সৌজন্যে, শুক্রবার   ৩১ অক্টোবর ২০২৫ ||  কার্তিক ১৫ ১৪৩২ :

৩১ অক্টোবর ১৯৫৩ — এই দিনে জন্ম নিয়েছিলেন এমন এক মানুষ, যার জীবন ছিলো আলোর প্রদীপ, জ্ঞানের বাতিঘর। যিনি সারাজীবন নিজেকে উৎসর্গ করেছেন শিক্ষা, মানবতা ও সমাজসেবার মহৎ ব্রতে। তিনি শ্রদ্ধেয় মোঃ আবদুস ছোবহান স্যার — এক আদর্শ শিক্ষক, দায়িত্বশীল পিতা, প্রেরণাদায়ী নেতা এবং সাদা মনের মানুষ; যার সততা, নীতিবোধ ও প্রজ্ঞার আলো আজও ছড়িয়ে পড়ছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।

Advertisement

এক স্বপ্নবাজ তরুণের সূচনা

১৯৭০-এর দশকের গ্রামীণ বাংলাদেশ তখনও উন্নয়ন ও শিক্ষার দিক থেকে অনেক পিছিয়ে। সুযোগ-সুবিধা সীমিত, শিক্ষা যেন ছিলো কেবল কিছু সৌভাগ্যবান পরিবারের নাগালে। সে সময়ের সাদামাটা গ্রামীণ পরিবেশে বেড়ে ওঠা এক তরুণ—আবদুস ছোবহান, তখন থেকেই বিশ্বাস করতেন,

শিক্ষাই একমাত্র শক্তি, যা ধনী–গরিবের ব্যবধান কমিয়ে মানুষকে যোগ্যতা ও মর্যাদার সমান আসনে বসায়, শিক্ষার আলো মাটির ঘর থেকে রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত সকলের জীবন আলোকিত করতে পারে।

এ বিশ্বাস থেকেই তিনি শিক্ষিত মানুষ গড়ার জন্য শিক্ষকতার পথ বেছে নেন।

শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই তার চিন্তা ও মনোযোগ ছিলো সমাজ ও মানুষকে পরিবর্তনের দিকে ধাবিত করা। তিনি বুঝতেন—একটি শিক্ষিত প্রজন্মই পারে জাতিকে এগিয়ে নিতে। এ অদম্য বিশ্বাস তাকে নিয়ে আসে শিক্ষকতার পবিত্র দায়িত্বে।

চার দশকের নিবেদন

১৯৭৩ থেকে ২০১০—প্রায় ৩৭ বছরের শিক্ষকতা জীবনের মধ্যে ৩১ বছর তিনি কাটিয়েছেন নিজ গ্রামের বিদ্যালয়ে। দীর্ঘ এ সময়ে তিনি গড়ে তুলেছেন অসংখ্য শিক্ষার্থী, যাদের জীবনে তিনি ছিলেন দিকনির্দেশক, পরামর্শদাতা ও অভিভাবক।

প্রতিটি শিক্ষার্থী তার কাছে ছিলো নিজের সন্তানের মতো প্রিয়। তিনি কখনও কেবল পাঠ্যবইয়ের শিক্ষক ছিলেন না—ছিলেন চরিত্র গঠনের আলোকবর্তিকা। প্রতিদিন সবার আগে স্কুলে পৌঁছাতেন, তালাবদ্ধ কক্ষ খুলে পাঠদান শুরু করতেন। দিনশেষে আবার নিজ হাতে স্কুলের দরজা-জানালা বন্ধ করে ফিরতেন বাড়ি। শিক্ষাদানের বাইরেও শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা, পারিবারিক সমস্যা কিংবা ব্যক্তিগত উদ্বেগের সময় পাশে দাঁড়াতেন নির্দ্বিধায়—বিনা প্রত্যাশায়, বিনা প্রতিদানে।

তার নিষ্ঠা ও নেতৃত্বে বিদ্যালয়টি অর্জন করেছিলো বিশেষ সুনাম। তার সময়েই স্কুলটি হোমনা–মেঘনা অঞ্চলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। দূরদূরান্তের শিক্ষার্থীরা আগ্রহভরে ভর্তি হতে আসত সেখানে—শুধু পড়াশোনার জন্য নয়, বরং একজন মহান শিক্ষকের সান্নিধ্য পাওয়ার আশায়।

নেতৃত্বে প্রজ্ঞা ও ন্যায়বোধ

শ্রদ্ধেয় ছোবহান স্যার শুধু শ্রেণিকক্ষের শিক্ষক নন, ছিলেন শিক্ষকদের ঐক্য ও উন্নয়নের অগ্রদূত। তিনি বিশ্বাস করতেন, শক্তিশালী শিক্ষক সমাজই গড়ে তুলতে পারে শক্তিশালী শিক্ষা ব্যবস্থা।

১৯৮৭ সালে শিক্ষকদের সরাসরি ভোটে তিনি নির্বাচিত হন ‘হোমনা উপজেলা সরকারি প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি’র সভাপতি। নিষ্ঠা, দূরদর্শিতা ও ন্যায্যতার সঙ্গে তিনি ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে ২০০৪ সালে মেঘনা উপজেলা গঠনের পর শিক্ষকদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে তিনি আবারও সভাপতি নির্বাচিত হন ‘মেঘনা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি’র। কোনও নির্বাচন ছাড়াই, কেবল বিশ্বাস ও ভালোবাসার ভিত্তিতে, তিনি অব্যাহত রাখেন দায়িত্ব পালন । তাছাড়া তিনি দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন চন্দনপুর মনির আহম্মদ উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদে, যেখানে তার পরিকল্পনা ও মননশীল সিদ্ধান্তে বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন এগিয়ে যায় বহুগুণে।

প্রশাসনিক দক্ষতা, সমস্যা সমাধানে বিচক্ষণতা এবং সিদ্ধান্তে ন্যায্যতা—এসব গুণ তাকে শিক্ষক সমাজে গভীর শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত করে। তার নেতৃত্বে বহু শিক্ষক তাদের পেশাগত জীবনে উন্নতির পথে অগ্রসর হয়েছেন।

Advertisement

প্রতিটি উপজেলায় সংবাদদাতা আবশ্যক। যোগাযোগ ০১৭১৪৪৯৭৮৮৫

প্রেরণার প্রতীক, মানবতার আলোকবর্তিকা

শিক্ষকতা থেকে অবসর গ্রহণের পরও শ্রদ্ধেয় স্যার থেমে যাননি। সমাজসেবার নানা কর্মকাণ্ডে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন আজও। স্থানীয় বিদ্যালয়, মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরস্থান কিংবা সামাজিক সংগঠন—সব জায়গাতেই রয়েছে তার অনুপ্রেরণাদায়ী ছাপ।

তার জীবনদর্শন খুব সহজ কিন্তু গভীর—‘মানুষের কল্যাণে কাজ করাই জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি।’ এ আদর্শে তিনি আজও তরুণ প্রজন্মের কাছে এক জীবন্ত উদাহরণ। তার পরামর্শে অনেক তরুণ পথ খুঁজে পেয়েছে জীবনের অন্ধকারে।

সাদা মন ও সাদা পোশাকের প্রতীক

ছোটবেলা থেকেই তাকে দেখেছি প্রতিদিন সাদা শার্ট পরে স্কুলে যেতেন। এখনও তার প্রিয় পোশাক সাদা পাঞ্জাবি। রঙে সামান্যতম ভিন্নতা থাকলেও তিনি সেটি পরেন না। যেন এ পোশাকই তার মন ও চরিত্রের প্রতীক—সাদা, নির্মল, বিনয়ী অথচ মর্যাদায় উজ্জ্বল।

এ সাদা পোশাক আমাদের শিখিয়েছে—সরলতাই সৌন্দর্য, সততাই শক্তি। তার জীবনের প্রতিটি অভ্যাস যেনো এক একটি শিক্ষার বার্তা—সময়ানুবর্তিতা, দায়িত্ববোধ, ন্যায্যতা এবং পরিচ্ছন্ন জীবনযাপন।

পরিবারে একজন আদর্শ মানুষ

পারিবারিক জীবনে তিনি যেমন একজন স্নেহময় পিতা, তেমনি দায়িত্বশীল স্বামী ও অনন্য পথপ্রদর্শক। তার সন্তানদের তিনি শিখিয়েছেন জীবনের মূলমন্ত্র—সততা, অধ্যবসায় ও মানবিকতা। তার আদর্শে গড়া পরিবার আজও সমাজে ইতিবাচক প্রভাব রেখে চলেছে।

তার সন্তানদের কাছে তিনি কেবল একজন পিতা নন, ছিলেন প্রেরণার উৎস, শৃঙ্খলার প্রতিমূর্তি এবং নৈতিকতার দিশারি। পরিবারের প্রতিটি সদস্য আজও গর্বভরে বলেন—

আমাদের বাবা ছিলেন একজন শিক্ষক, যিনি শুধু পাঠদান করেননি, শিখিয়েছেন মানুষ হওয়া।

এক আলোকিত জীবনের দিশা

শ্রদ্ধেয় ছোবহান স্যার তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে সমাজ, শিক্ষা ও মানবতার সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। তার মতো মানুষ কেবল শিক্ষক নন—তারা সমাজের স্থপতি।

আজ ৩১ অক্টোবর এ মহান শিক্ষকের জন্মদিনে আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি সে মানুষটিকে, যিনি নিজের জীবনে যে নীতি অনুসরণ করেছেন—সেটাই আজও আমাদের আলোকিত করে।

তার হাতে গড়া অসংখ্য শিক্ষার্থী আজ দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে আছে নানা পেশায়—ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, প্রশাসক, সাংবাদিক, উদ্যোক্তা। কিন্তু তারা যখন একত্রিত হন, তখন সবার মুখে এক নামই উচ্চারিত হয়—‘ছোবহান স্যার’। সে উচ্চারণের মধ্যেই লুকিয়ে আছে শত শত হৃদয়ের কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা।

আজকের দিনে শ্রদ্ধা

৩১ অক্টোবর—এ দিনে আমরা তাকে স্মরণ করি অসীম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়। তার জীবনের প্রতিটি অধ্যায় যেন এক শিক্ষা, এক দিশা, এক আদর্শ।

তিনি আমাদের শিখিয়েছেন—মানুষের প্রতি ভালোবাসা, পেশার প্রতি নিষ্ঠা এবং জীবনের প্রতি দায়িত্ববোধই মানুষকে করে অমর। তার আদর্শ, তার সাদা জীবনের প্রতিফলন আমাদের প্রত্যেকের জন্য এক আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবে—যতদিন শিক্ষা, সততা ও মানবতার মূল্য থাকবে পৃথিবীতে।

Advertisement

শুভ জন্মদিন প্রিয় শিক্ষক, প্রিয় মানুষ— মোঃ আবদুস ছোবহান স্যার। আপনার জীবন হোক দীর্ঘ, সুস্থ ও শান্তিময়।

আপনার আলো ছড়িয়ে যাক আমাদের সকলের জীবনের প্রতিটি প্রান্তে।