ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (ভিডিও),বিনোদন প্রতিনিধি, বৃহস্পতিবার ২৩ অক্টোবর ২০২৫ || কার্তিক ৭ ১৪৩২ :
বাংলা চলচ্চিত্রের নব্বই দশকের সুপারহিট নায়ক সালমান শাহের মৃত্যুর ২৯ বছর পর তার অকাল প্রয়াণকে ঘিরে এতদিন ধরে চলে আসা আলোচনা নতুন মোড় নিয়েছে। প্রায় তিন যুগ ধরে অপমৃত্যু বলা হলেও এ ঘটনায় হওয়া মামলার রিভিশন আবেদনের রায়ের প্রেক্ষিতে নতুন করে দায়ের করা হয়েছে হত্যা মামলা। রায়ে উল্লেখিত আসামি রেজভী আহমেদ ওরফে ফরহাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে সালমান শাহ আত্মহত্যা করেননি, তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে উঠে এসেছে। মিলেছে হত্যার পুরো ঘটনার বিবরণও।
Advertisement
জবানবন্দিতে বলা হয়েছে, সালমান শাহকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে কিলার ভাড়া করেন তার শাশুড়ি লতিফা হক লুসি। হত্যার পরিকল্পনা সাজানো হয় রাজধানীর গুলিস্তানের একটি বারে বসে। কিলারদের সঙ্গে চুক্তি হয় ১২ লাখ টাকায়। দেশের অঘোষিত আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন হিসেবে আলোচিত আজিজ মোহাম্মদ ভাই, খলনায়ক ডন, সালমানের স্ত্রী সামিরা হকসহ আরও ১১ জন অংশ নেন এই হত্যাকাণ্ডে। হত্যার পর ঘটনা ধামাচাপা দিয়ে আত্মহত্যা বলে প্রচার চালিয়ে পরিস্থিতি ঠাণ্ডা করেন আজিজ মোহাম্মদ ভাই।
সালমানের পরিবারের দীর্ঘ ২৯ বছরের আইনি লড়াই শেষে সামিরা, ডনসহ ১১ বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করতে রায় দিয়েছেন ঢাকার ষষ্ঠ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. জান্নাতুল ফেরদৌস ইবনে হক। এরই মধ্যে রমনা থানার দায়ের হওয়া এ হত্যা মামলাটি তদন্ত করে আগামী ৭ ডিসেম্বর প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। মামলার অন্য আসামিরা হলেন, ডেবিড, জাভেদ, ফারুক, রুবী, আ. ছাত্তার, সাজু ও রেজভী আহমেদ ওরফে ফরহাদ।
রায়ের বিবরণী থেকে জানা যায়, ১৯৯৭ সালে সালমান শাহর মৃত্যুর ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ক্যান্টনমেন্ট থানার আরেকটি মামলায় আদালতে হত্যাকাণ্ডে নিজের সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ করে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দেন আসামি রেজভী আহমেদ ওরফে ফরহাদ। তিনি জবানবন্দিতে বলেন, সালমান শাহ আত্মহত্যা করেননি। এটি একটি পরিকল্পিত হত্যা। জবানবন্দিতে রেজভী বলেন, ‘ডন সালমান শাহর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। সালমানের স্ত্রী সামিরার সঙ্গে ডনের গোপন সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং দৈহিক সম্পর্কও ছিল। অন্যদিকে সামিরার মায়ের সঙ্গে চিত্র প্রযোজক আসামি আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের গোপন ও দৈহিক সম্পর্ক ছিল। তাই সালমান ডনকে এড়িয়ে চলতেন।’
হত্যার পরিকল্পনার বিষয়ে রেজভী বলেন, ‘সালমান শাহকে হত্যার আগের দিন ১৯৯৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর গুলিস্তানের একটি বারে পরিকল্পনা করা হয়। ওইদিন রাত ৮টায় ডন, ডেভিড, ফারুক, জাভেদ ও আমি বারে যাই। সেখানে আরও ২ জন ছেলে ছাত্তার ও সাজু আসে। এরপর ফারুক ২ লাখ টাকা বের করে বলে, সামিরার মা ওই টাকা দিয়েছে। কথা ছিল সালমানকে শেষ করার জন্য মোট ১২ লাখ টাকা দেবে। কাজের আগে ৬ লাখ ও কাজের পরে ৬ লাখ। কিন্তু ২ লাখ টাকা পেয়ে ডনের সঙ্গে ফারুকের কথাকাটাকাটি হয়। পরে ফারুক রাগ করে বাইরে যায়। ২০ থেকে ২৫ মিনিট পরে আরও ৪ লাখ টাকা নিয়ে আসে। তখন ওখানেই ডন প্লাস্টিকের একটি দড়ি নিজের মাজায় বেঁধে উপরে কালো জ্যাকেট গায়ে দেয়। বাকি অর্ধেক রশি ফারুকের কাছে দেয়। এরপর তারা টাকা, সিরিঞ্জ, রিভলবার ইত্যাদি গুছিয়ে নেয়। সামিরার মা এবং আজিজ মোহাম্মদ ভাই দুজনে মিলেই সালমানকে শেষ করার ব্যাপারে ডন ও ফারুকের সঙ্গে কনটাক্ট হয়।’
রেজভী আরও বলেন, ‘এরপর ওই রাতে বার থেকে এফডিসি এসে শুটিং শেষে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী রাত আড়াইটার সময় আমাকে সালমান শাহর বাসায় নিয়ে যায় ডন। ওই বাসায় ডন, ডেভিড ও ফারুকের যাতায়াত ছিল বলে দারোয়ান কিছু বলেনি। সালমানের বাসায় লিফটে ওঠার আগেই ডান পাশে রুবী নামে এক মেয়ের রুমের দরজায় ডন নক করলে রুবী নাইটি পরা অবস্থায় দরজা খোলে।
Advertisement
প্রতিটি উপজেলায় সংবাদদাতা আবশ্যক। যোগাযোগ ০১৭১৪৪৯৭৮৮৫
এরপর বলে, “ও তোমরা এসেছ।” তখন ডন রুবীকে বলে, ‘আজিজ ভাই কোথায়?’ বাথরুম থেকে আজিজ ভাই বের হয়ে আসে। এরপর আমরা উপরে উঠি। আজিজ ভাই চারতলায় নেমে যায়। আর আমরা ১১ তলায় নেমে সালমানের বাসায় যাই। দরজা আগে থেকেই চাপানো ছিল। দরজা খুলেই দেখা যায় সালমান বেডরুমে শুয়ে আছে। পাশে সামিরা নাই। তখন ডন, ডেভিড, জাভেদ, ফারুকরা মিলে সালমানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ সময় ফারুক তার পকেট থেকে ক্লোলোফর্মের সিসি বের করে সামিরাকে দেয়। সামিরা তা দিয়ে সালমানের নাকের ওপর চেপে ধরে। ডন সালমানের বুকের ওপর গিয়ে বসে। আর ফারুককে বলে, আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে ডাক। ফারুক তখন বাইরে গিয়ে আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে নিয়ে আসে। এরই মধ্যে সামিরার মা ড্রেসিংরুম থেকে বের হয়ে আসে। তখন ধস্তাধস্তি হচ্ছিল। সালমানের খুব শক্তি ছিল। ইনজেকশন দেওয়া যাচ্ছিল না। তখন সবাই মিলে সালমানকে ড্রেসিং রুমে নিয়ে ডেভিড সালমানের পা বাঁধে। আজিজ ভাই ডনকে ইনজেকশন দিতে বলে। পরে সামিরা পুশ করে, তার মা সামিরাকে পুশ করতে সাহায্য করে। পরে সালমান নিস্তেজ হয়ে পড়ে। ইনজেকশন পুশ করার আগে আজিজ মোহাম্মদ ভাই ফ্যানটা সালমান শাহর ঘাড়ের ওপর ছুড়ে মেরেছিল। ড্রেসিং রুমে একটা মই ছিল। আজিজ মোহাম্মদ ভাই আমাকে মইটা আনতে বলে। আমি এনে দিই। এরপর তিনি দড়ি চান। তখন ডন নিজের কোমরের দড়িটা খুলে আজিজ ভাইয়ের হাতে দেয়। আজিজ মোহাম্মদ ভাই নিজেই সিঁড়ি দিয়ে উঠে দড়িটি সিলিং ফ্যানের সঙ্গে বাঁধে। তাতে আমি, সামিরা, সামিরার মা সাহায্য করি। পরে সালমানের পায়ে বাঁধা রশিটা খুলে বুকের ওপর উঠে গলায় চাপ দিয়ে রাখে এবং পরীক্ষা করে দেখে যে নিঃশ্বাস নেই। উপরের রশিটা খানিকটা ঝুলিয়ে রাখা হয়, যাতে দেখানো যায় যে, লাশটাকে ঝোলানো থেকে খোলা হয়েছে। পরে সালমান সুইসাইড করেছে এটা দেখানোর জন্য তাকে তেল মালিশ করা হয়, কাপড় ভিজিয়ে শরীরে রাখা হয়। এরপর যে যার মতো চলে যাই। আমিও ফরিদপুর চলে যাই। এরপর কারও সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি। কিছুদিন পর ডনের সঙ্গে ঢাকায় দেখা হলে আমাকে জানায় দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নাই। আজিজ মোহাম্মদ ভাই সব ঠান্ডা করে দিয়েছে। পরে আমি আবার বাড়িতে গেলে ১৯৯৭ সালের ৪ঠা জুলাই ডন ও ডেভিড আমাদের বাড়িতে আসে। ডন আমাকে বলে, কেইসটা আবার নাড়া দিয়ে উঠেছে। যেহেতু আমাদের সঙ্গে ছিলে। এখন আমাদের সাহায্য করতে হবে। আমাকে তারা প্রয়াত চিত্রপরিচালক আলমগীর কবিরের ছেলে লেনিন সেজে সালমানের বাবা-মার বাসায় যেতে বলে। এরপর গভীর রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় সালমানের ছোট ভাই বিল্টুকে অপহরণ করে সালমান হত্যা মামলা প্রত্যাহার করা হবে বলে পরিকল্পনা হয়। তবে ওই বাসায় লেলিন সেজে গেলে আমি ধরা পড়ি। সালমান শাহ আত্মহত্যা করেনি। এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।’
শুধু আসামি রেজভীই নয়, আসামি রুবীও স্বীকার করেন এটি একটি হত্যাকাণ্ড। আদালতের পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, রেজভী আহমেদের দোষ স্বীকারোক্তি অবজ্ঞা করার আইনগত কোনো সুযোগ নেই। তিনি জবানবন্দিতে ভিকটিম সালমান শাহকে হত্যা করার কথা বলেছেন। কিন্তু ওই স্বীকারোক্তির পরও পুলিশ কর্তৃক সালমান শাহকে হত্যার অভিযোগে কোনো এজাহার দায়ের করা হয়নি। এতে আইনের ব্যত্যয় ঘটেছে বলে আদালত পর্যবেক্ষণে বলেছেন। একই সঙ্গে ১৯৯৭ সালে সালমানের বাবা করমউদ্দিন চৌধুরীর হত্যা মামলা দাখিলের আবেদন ও আসামি রেজভীর স্বীকারোক্তির অনুলিপি সংযুক্ত করে রমনা থানায় হত্যা মামলার এজাহার দায়েরের নির্দেশ দেন আদালত।
এই নির্দেশের পর গত সোমবার মধ্যরাতে সালমান শাহর মা নীলা চৌধুরীর পক্ষে তার ভাই মোহাম্মদ আলমগীর কুমকুম বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেন। এ রায়ের বিষয়ে সালমানের মা নীলা চৌধুরী বলেন, ‘হত্যা মামলার যারা তদন্ত করল না, ২৯ বছরে সাক্ষী সব নষ্ট করে মামলাটাকে আত্মহত্যা বলে প্রমাণ করতে চাইলো তাদের বিচার চাই।’
Advertisement
সালমান শাহ হত্যা মামলার আইনজীবী আবিদ হাসান বলেন, ‘এ ঘটনায় আরও আগেই হত্যা মামলা হওয়া উচিত ছিল। আসামি রেজভীর জবানবন্দিতে কীভাবে স্ত্রী সামিরা, ডন, আজিজ মোহাম্মদসহ বাকি আসামিরা সালমান শাহকে হত্যা করে সব আছে। আমরা এ হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।’