বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের কাছে সাংবাদিক-ছাত্র ইউনিয়ন নেতার চাঁদাবাজি!(ভিডিও)

SHARE

চাঁদাবাজির অভিযোগ ওঠা কালবেলার সাংবাদিক সাজ্জাদ হোসেন সজীব (বাঁ থেকে), খবরের কাগজের সিরাজুল ইসলাম সুমন ওরফে এস আই সুমন, রাবি ছাত্র ইউনিয়নের (একাংশের) সাধারণ সম্পাদক আতাউল্লাহ ও আইন বিভাগের ছাত্র নাজমুস সাকিব। ছবি: সংগৃহীত

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম(টিভি),রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি ,শনিবার   ১৭ মে ২০২৫ ||  জ্যৈষ্ঠ ৩ ১৪৩২ :

ছাত্রীর সঙ্গে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ফাইন্যান্স বিভাগের শিক্ষকের ‘আপত্তিকর’ ঘটনা ধামাচাপা দিতে মোটা অঙ্কের টাকা চাঁদা নেওয়া অভিযোগ উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মরত দুজন সাংবাদিক, ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সমন্বয়ক এবং একজন ছাত্রের বিরুদ্ধে।

Advertisement

এ বিষয়ে আজ শনিবার সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন মার্কেটের আমতলায় উভয়পক্ষ পাল্টা-পাল্টি সংবাদ সম্মেলন করেছেন।

চাঁদাবাজির অভিযোগ ওঠা চারজন হলেন কালবেলার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি ও রাবি সাংবাদিক সমিতির (রাবিসাস) যুগ্ম সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন সজীব, খবরের কাগজের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি ও রাবিসাসের সহসভাপতি সিরাজুল ইসলাম সুমন ওরফে এস আই সুমন, ছাত্র ইউনিয়ন (একাংশের) রাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সহসমন্বয়ক (আইবিএ বিভাগের ছাত্র) আতাউল্লাহ এবং আইন বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র নাজমুস সাকিব।

চাঁদাবাজির অভিযোগ তোলা ছাত্রীর নাম মারিয়া খাতুন (২৫)। তিনি ফাইন্যান্স বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের স্নাতকোত্তরের (এমবিএ) ছাত্রী। তিনি স্নাতকের প্রকাশিত ফলাফলে বিভাগে যৌথভাবে দ্বিতীয়। গত ১১ মে সন্ধ্যায় ছুটির দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একাডেমিক ভবনের ৩০৭ নম্বর কক্ষে ওই ছাত্রী এবং একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহকে আপত্তিকর অবস্থায় পাওয়া যায়। এ ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

গত ১৪ মে বিষয়টি নিয়ে আমাদের সময় অনলাইনে ‘রাবি শিক্ষকের কক্ষে আপত্তিকর অবস্থায় ছাত্রী, হাতেনাতে ধরা’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ হয়। পরের দিন পত্রিকাতেও প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়।

Image not found

৩ লাখ টাকা চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ

ওই ঘটনা প্রকাশ হওয়ার পর ১৫ মে ছাত্রী মারিয়া খাতুন বাদী হয়ে নগরীর মতিহার থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। সেখানে ওই চারজনের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ আনা হয়।

আজ সংবাদ সম্মেলন মারিয়া খাতুন বলেন, ‘গত রবিবার আমি ৫টার দিকে স্যারের চেম্বারে যাই। সন্ধ্যা ৬টা ৪০ মিনিটের পরে তারা (অভিযুক্ত চারজন) দরজায় নক করে। প্রথমে আমরা টের পাই নাই। এর কিছুক্ষণের মধ্যে তারা ঢুকে যায়। প্রথমে দুজন ঢোকে… তারপর আর দুজন। রুমে ঢুকে তারা প্রথমে আমার গায়ে হাত দিলে আমার গা থেকে ওড়না পড়ে যায়। তখন স্যারের সঙ্গে হাতাহাতি হয়।’

চাঁদাবাজির বিষয়ে ওই ছাত্রী বলেন, ‘তারা মোবাইলে ভিডিও করার কথা বললে আমি টেবিলের তলে গিয়ে লুকাই। পরে তারা বের হওয়ার জন্য জোর করলে আমি গামছা মাথায় নিয়ে বের হই। তারা প্রথম ৫ লাখ টাকা দাবি করে। স্যার আমার নিরাপত্তার ভয়ে একপর্যায়ে টাকা দিতে রাজি হয় এবং চেম্বার থেকে বের হয়ে জুবেরী ভবনের দিক থেকে এক লাখ টাকা নিয়ে দেয়। পরের দিন তাদের আরও দুই লাখ টাকা দিতে হয়।’

সাংবাদিকদের পাল্টা অভিযোগ

ছাত্রীর অভিযোগ অস্বীকার করে পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করেছেন সাংবাদিক সাজ্জাদ ও সুমন। তারা জানান, গত ১১ মে সন্ধ্যায় এক শিক্ষকের মাধ্যমে ঘটনা সম্পর্কে জেনে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অনুমতি নিয়ে তারা সেখানে যান। সেখানে গিয়ে দেখেন, শিক্ষক হেদায়েত উল্লার কক্ষের লাইট বন্ধ। তখন তারা কড়া নাড়লে ওই শিক্ষক দরজা খুলে দেন। তখন কক্ষে প্রবেশ করে ওই শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলার একপর্যায়ে টেবিলের নিচে ওই ছাত্রীকে লুকিয়ে থাকতে দেখি। পরে হেদায়েত উল্লাহ নিজেই ছাত্রীকে টেবিলের নিচ থেকে বের করে আনেন। এ সময় ছাত্রীর অনুরোধ করেন, ভিডিও বা সংবাদ প্রকাশ যেন না করা হয়—অন্যথায় তিনি আত্মহত্যার মতো চরম সিদ্ধান্ত নিতে পারেন বলে হুমকি দেন।

তারা আরও বলেন, তাৎক্ষণিকভাবে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরকে ফোন করে বিষয়টি জানান। পরে হেদায়েত উল্লাহর অনুরোধে পরে বিষয়টি আর প্রক্টরকে বলেননি। এ সময় ওই ছাত্রীর নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করে তারা ভিডিও প্রকাশ না করার সিদ্ধান্ত নেন। পরে তাদের অজ্ঞাতে একটি সোর্সের মাধ্যমে ঘটনার ভিডিওটি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। তাদের সঙ্গে অভিযুক্ত শিক্ষক বা ছাত্রীর কোনো ধরনের আর্থিক লেনদেন হয়নি। তাদের উদ্দেশ্য ছিল কেবলমাত্র একটি অনৈতিক ঘটনার যথাযথ প্রতিবাদ ও প্রশাসনকে অবহিত করা।

সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রীর তোলা চাঁদাবাজির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন অভিযুক্ত নাজমুস সাকিব। তবে অভিযোগের বিষয়ে জানতে আরেক অভিযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের (একাংশ) সাধারণ সম্পাদক ও সমন্বয়ক মো. আতাউল্লাহর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তাকে প্রথমে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজের মাধ্যমে মন্তব্য জানাতে চাইলেও পরে আর জানাননি। পরবর্তীতে মোবাইল ফোনে আবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি ধরেননি।

চারজনকে চাঁদা দেওয়ার বিষয়ে মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ বলেন, ‘হ্যাঁ, আমি তাদের প্রথম ও দ্বিতীয় দিন মিলিয়ে তিন লাখ টাকা দিয়েছি। প্রথম দিন তাৎক্ষণিক এক লাখ টাকা দিয়েছিলাম। কারণ তারা ওখানে মেয়েটিকে রেপ করার হুমকি দিয়েছিল এবং ভীতিকর একটা পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। আর দ্বিতীয় দিন আবার দুই লাখ টাকা দিতে বাধ্য হয়েছি।’

Advertisement

ছাত্রীর জিডির বিষয়ে জানতে মতিহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আব্দুল মালেকের সঙ্গে মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।

সাংবাদিকরা মিথ্যা বলেছেন, জানালেন প্রক্টর

অভিযুক্ত দুই সাংবাদিক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন, প্রক্টরের অনুমতি নিয়ে তারা চারজন সহযোগী অধ্যাপক হেদায়েত উল্লাহর চেম্বারে গিয়েছিলেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মাহবুবর রহমান বলেন, ‘প্রশ্নই আসে না! কোনোরকম অনুমতি নিয়ে যায়নি। মিথ্যা-বানোয়াট তথ্য ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে। সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের জানতে চাওয়ার দরকার ছিল যে, প্রক্টর কীভাবে অনুমতি দিয়েছে? কোনো অনুমতিপত্র আছে কি না।’

প্রক্টর আরও বলেন, ‘ওই দিন সন্ধ্যায় সমন্বয়ক আতাউল্লাহ আমাকে একটা কল দিয়ে শুধু বলেছিল যে, “স্যার একজন শিক্ষকের চেম্বারে একজন ছাত্রী দীর্ঘক্ষণ অবস্থান করছে।” আমি তখন ক্যাম্পাসের বাইরে ছিলাম। ক্যাম্পাসে এসে আতাউল্লাহকে ৪-৫ বার কল দিলেও সে আর কল রিসিভ করেনি। এখন তারা ওই কল দেওয়াটাকে অনুমতি হিসেবে বলে বেড়াচ্ছে। অথচ খবরটা প্রকাশিত হওয়ার পর (থানায় অভিযোগ জানানো) থেকে তারা আমাদের হাতেপায়ে ধরছে যে, “স্যার আমাদের বাঁচান। আমরা ভুল করে ফেলেছি। আপনারা বললে মামলা হবে না।” বিভিন্ন গোষ্ঠীর মাধ্যমে চাপও দেওয়াচ্ছে। আবার এ ধরনের মিথ্যা তথ্য দিয়ে আমাদের বিব্রত করছে।’

সামগ্রিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীব বলেন, ‘সব কিছুই এখন তদন্তের মধ্য দিয়ে যাবে। তদন্ত শেষ হওয়ার আগে আমি এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাচ্ছি না। আমাদের একটু ধৈর্য্য ধরতে হবে পুরো ঘটনাটা জানার জন্য।’

প্রসঙ্গত, গত ১১ মে বুদ্ধ পূর্ণিমা উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি ছিল। ওই দিন বিকেল ৫টার দিকে ছাত্রী মারিয়া খাতুনকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অ্যাকাডেমিক ভবনের ৩০৭ নম্বর কক্ষে (নিজের চেম্বার) প্রবেশ করেন সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ। ওই দিনের ওই কক্ষের একটি ভিডিও ফেসবুকে গত ১৪মে ছড়িয়ে পড়ে। যেখানে দেখা যায়, ভিডিও করার সময় ওই শিক্ষক ও ছাত্রী নিজেদের মুখ ঢাকার চেষ্টা করছেন। এরপর দুই দিন পরে ভিডিও প্রকাশ হওয়া নিয়ে ক্যাম্পাসে নানা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। অনেকে আর্থিক লেনদেনের কথাও তোলেন তখন।

Advertisement

শিক্ষক-ছাত্রীকে বিভাগের একাডেমিক কার্যক্রম থেকে বহিষ্কারের সুপারিশ

আপত্তিকর অবস্থায় আটকের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের শিক্ষক ও ছাত্রীকে বিভাগের সব ধরনের একাডেমিক কার্যক্রম থেকে বিরত রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। অভিযোগটি অধিকতর তদন্তের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে পাঠানো হবে। গতকাল আজ শুক্রবার দুপরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের একাডেমিক কমিটির বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেন শিক্ষকরা।