ত্বকী হত্যার ১১তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ: বিচার শুরুর অপেক্ষায়ই কাটলো এগারো বছর (ভিডিও)

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি,বুধবার, ০৬ মার্চ ২০২৪  : মামলার নথিপত্র আদালতে উঠেছে অন্তত ৭০ বার। আদালত তাগিদও দিয়েছেন কিন্তু দীর্ঘ ১১ বছরেও নারায়ণগঞ্জের মেধাবী কিশোর তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যা মামলার অভিযোগপত্র জমা দিতে পারেনি তদন্তকারী সংস্থা র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র‍্যাব)। এতে শুরু করা যায়নি মামলাটির বিচার কার্যক্রম।

যদিও হত্যাকাণ্ডের এক বছরের মাথায় সংবাদ সম্মেলন করে র‍্যাবের তৎকালীন অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্ণেল জিয়াউল আহসান সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছিলেন, ত্বকী হত্যার কারণ স্পষ্ট, আসামিও চিহ্নিত। অভিযোগপত্রও প্রায় তৈরি। অল্প সময়ের মধ্যে তা আদালতে দাখিল করা হবে। যা দীর্ঘ ১০ বছরেও সম্ভব হয়নি।

Advertisement

নিহত ত্বকীর পিতা রফিউর রাব্বির অভিযোগ, নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী ওসমান পরিবারের লোকজন এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত বলে প্রধানমন্ত্রীর ‘অঘোষিত ইনডেমনিটি’র কারণে তৈরি করে রাখা অভিযোগপত্র আদালতে আর জমা দেয়নি র‍্যাব।

২০১৩ সালের ৬ মার্চ বিকেলে শহরের শায়েস্তা খাঁ সড়কের বাসা থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হয় মেধাবী কিশোর তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী। পরদিনই মেধাবী এই কিশোরের এ লেভেল পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়। ফলাফলে জানা যায়, ত্বকী পদার্থবিজ্ঞানে (২৯৭/৩০০) সারাবিশ্বে এবং রসায়নে (২৯৪/৩০০) বাংলাদেশের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পায়। এই রেজাল্টশিট দেখার সৌভাগ্য হয়নি। ৮ মার্চ সকালে শহরের পাঁচ নম্বর ঘাট এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীর শাখা খাল (কুমুদিনী খাল) থেকে তার মরদেহ উদ্ধার হয়।

নিখোঁজ হওয়ার দিন বিকেলে শহরের সুধীজন পাঠাগার হয়ে চাষাঢ়ায় বাবার ব্যবসায়িক কার্যালয়ে যাওয়ার কথা ছিল ত্বকীর। সেখানে না যাওয়ায় অনেক খোঁজাখুজির পর সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন ত্বকীর পিতা রফিউর রাব্বি। মরদেহ উদ্ধারের পর অজ্ঞাত আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। পরে ১৮ মার্চ নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমান, তার ছেলে অয়ন ওসমান, জেলা যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা জহিরুল ইসলাম পারভেজ ওরফে ক্যাঙারু পারভেজ, জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি রাজীব দাস, সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান সুজন, সালেহ রহমান সীমান্ত ও রিফাত বিন ওসমানকে ত্বকী হত্যার সাথে জড়িত উল্লেখ করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশ সুপার কার্যালয়ে একটি অবগতিপত্র দেন রফিউর রাব্বি।

তিনি অভিযোগ করেন, ত্বকীকে অপহরণের পর আজমেরী ওসমানের ‘টর্চার সেল’ উইনার ফ্যাশনে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। বাদীর আবেদনে উচ্চ আদালতের নির্দেশে মামলাটি থানা পুলিশ থেকে ২০ জুন র‍্যাবে হস্তান্তর হয়। এরপর ৭ আগস্ট উইনার ফ্যাশনে অভিযান চালায় র‍্যাব। সেখান থেকে রক্তমাখা জিন্স প্যান্ট, পিস্তলের বাট, ইয়াবা সেব‌নের সরঞ্জাম উদ্ধারের কথা জানায় র‍্যাব। ওই সময় উদ্ধার হওয়া রক্তমাখা জিন্স প্যান্টটি তরুণ আশিকুল ইসলামের বলে দাবি করেছিলেন রফিউর রাব্বি। আশিক তার চাচাতো বোনের ছেলে। ২০১১ সালের ১১ মে সন্ধ্যায় নিখোঁজ হওয়ার দু’দিন পর শীতলক্ষ্যা থেকে মেলে আশিকের অর্ধনগ্ন মরদেহ। আশিকের মৃত্যুর পেছনেও ওসমান পরিবারের লোকজনের সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছিল।

ত্বকী হত্যা মামলায় পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এদের মধ্যে ইউসুফ হোসেন লিটন ও সুলতান শওকত ভ্রমর ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। জবানবন্দিতে তারা এই হত্যাকাণ্ডে নিজেদের জড়িত থাকার পাশাপাশি আজমেরী ওসমানসহ অন্যদের নামও প্রকাশ করেন।

Advertisement

নিহত ত্বকী নারায়ণগঞ্জের সাংস্কৃতিক ও নাগরিক আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক শিল্পী রফিউর রাব্বির বড় ছেলে। বাবা রফিউর রাব্বিকে শায়েস্তা করতেই ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে বলে ২০১৪ সালের ৫ মার্চ সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিল র‍্যাবের তৎকালীন অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্ণেল জিয়াউল আহসান। আজমেরী ওসমান যিনি শহরে ‘হাজী সাহেব’ নামে পরিচিত এবং যার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শহরজুড়ে চর্চিত তার পরিকল্পনা, নির্দেশ ও সক্রিয় অংশগ্রহণে ত্বকীকে অপহরণের পর নির্যাতনে হত্যা করা হয় বলেও জানায় র‍্যাব।

অভিযুক্ত আজমেরী ওসমানের পিতা প্রয়াত একেএম নাসিম ওসমান জাতীয় পার্টি থেকে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে চারবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন। তার দুই চাচা একেএম শামীম ওসমান নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য এবং একেএম সেলিম ওসমান নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ও বিকেএমইএ’র সভাপতি।

Advertisement

সংবাদ সম্মেলনে তদন্তের একটি ‘খসড়া প্রতিবেদন’ সাংবাদিকদের কাছে সরবরাহ করে তদন্তকারী সংস্থাটি। সেখানে হত্যার কারণ ও জড়িতদের বিষয় সবিস্তারে উল্লেখ করা হয়।

ত্বকী হত্যাকাণ্ডের প্রথম বর্ষপূর্তিতে র‍্যাবের ঊর্ধ্বতন ওই কর্মকর্তা গণমাধ্যমে এসব তথ্য তুলে ধরেন। যা ওই সময় সব গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়।

ওই সময় র‍্যাব আরও জানায়, আজমেরী ওসমানের নির্দেশে এবং প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে সহযোগীদের নিয়ে ত্বকীকে হত্যা করা হয়। পরে লাশ ফেলা হয় শীতলক্ষ্যা নদীর শাখা খালে। অচিরেই এই হত্যাকারণ্ডের অভিযোগপত্র দাখিল করার কথা জানালেও তা আর আলোর মুখ দেখেনি। এদিকে গ্রেপ্তার আসামিরাও জামিনে বেরিয়ে এসে এখন পলাতক। শুরুতে এই মামলা নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানা তদন্ত করলেও উচ্চ আদালতের নির্দেশে তদন্তের দায়িত্ব পায় র‍্যাব-১১।

‘হত্যার কারণ স্পষ্ট ও আসামিরা চিহ্নিত’ হওয়ার পরও অভিযোগপত্র দাখিল না করায় বিচার পাওয়ার ভুক্তভোগী পরিবার সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে মন্তব্য করেন এই হত্যা মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী প্রদীপ কুমার ঘোষ।

Advertisement

তিনি বলেন, ‘তদন্তকারী সংস্থা র‍্যাব দেশের সকল গণমাধ্যমকর্মীদের ডেকে সংবাদ সম্মেলনে কে, কেন, কীভাবে ত্বকীকে হত্যা করেছে বিস্তারিত জানিয়েছে। এই মামলায় গ্রেপ্তার সুলতান শওকত ভ্রমর ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে আজমেরী ওসমানসহ একাধিক ব্যক্তির এই হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িতের কথা বলেছে। এই হত্যা মামলার সবকিছুই স্পষ্ট। তারপরও আদালতে অভিযোগপত্র দিচ্ছে না র‍্যাব। এই মামলাটি এখন পর্যন্ত ৭০ বার আদালতে উঠেছে। আদালত তাগিদ দিলেও কোন তারিখেই র‍্যাব তাদের অভিযোগপত্র এখন পর্যন্ত জমা দেয়নি। রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন কর্তা-ব্যক্তিরা এগিয়ে না আসলে ভুক্তভোগী পরিবার বিচার পাওয়ার যে সাংবিধানিক অধিকার তা থেকে বঞ্চিত হতে হবে।’

মামলাটির সর্বশেষ তারিখ ২০ ফেব্রুয়ারি গিয়েছে। ওইদিনও র‍্যাব তদন্তের জন্য আরও সময় চেয়ে আবেদন করে বলে জানান বলে জানান প্রদীপ ঘোষ।

জানতে চাইলে মামলাটির তদন্তকারী সংস্থা র‍্যাব-১১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্ণেল তানভীর মাহমুদ পাশার দাবি, মামলাটি এখনও তদন্তাধীন। তদন্ত শেষ করতে আরও সময় লাগবে বলে জানান।

Advertisement

নিহত ত্বকীর পিতা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বি বলেন, ‘এই হত্যাকাণ্ডের কোন কিছুই কারও অজানা নয়। আমরা বারবার বলে আসছি, এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে শামীম ওসমান, তার ছেলে অয়ন ওসমান, ভাতিজা আজমেরী ওসমানসহ তাদের সহযোগীরা সরাসরি যুক্ত। র‍্যাব এক বছরের মাথায় সংবাদ সম্মেলন করে সবই জানালো।

দীর্ঘসূত্রিতা থাকলেও এই হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে এবং দোষীরা শাস্তি পাবেন বলে আশাবাদী সন্তানহারা এই পিতা। তিনি বলেন, ‘ত্বকী হত্যার বিচার হবেই। এই সরকার থাকতে হোক কিংবা পরেই হোক। এই হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টান্তমূলক বিচার হবে।’