আমি কি বিএনপি ভাঙার মতো নেতা? (ভিডিও)

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),সমকাল সৌজন্যে,বৃহস্পতিবার, ২৩ মার্চ ২০২৩ : বিএনপি ভেঙে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করার ব্যক্তিগতভাবে কোনো অভিপ্রায় নেই বলে দাবি করেছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান পদ থেকে সদ্য বহিষ্কৃত শওকত মাহমুদ। তিনি বলেছেন, বরং তাঁর কাছে এটা মনে হয়েছে– যাঁরা একটা ভিন্ন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম করতে যাচ্ছেন বা চাচ্ছেন, তাঁদের সতর্ক করার জন্যই এমন বহিষ্কার। একই সঙ্গে তিনি বলেন, আমরা নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে জাতীয় সরকারের প্রস্তাব করেছি। এটা গ্রহণ করা বা না করা রাজনৈতিক দলগুলোর এখতিয়ার। এটা হয়তো বিএনপি ভুল বুঝেছে। আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারত– বিষয়টা কী। তারা এটা করেনি। এটা অমূলক কাজ হয়েছে। আশা করি, বিএনপি ভুল সংশোধন করে নেবে। মঙ্গলবার বিএনপি থেকে বহিষ্কারের পর গতকাল বুধবার সমকালকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে শওকত মাহমুদ এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, বিএনপির কোনো নেতা বা সাবেক এমপির সঙ্গে দল ভাঙার ব্যাপারে তাঁর কোনো ধরনের যোগাযোগ  নেই। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার জন্য আমার মতো নেতা কেন বেছে নেবে সরকার– এটাই তো একটি বড় প্রশ্ন। আমি কি ওই পর্যায়ের নেতা– বিএনপি ভাঙতে কাজ করব!

Advertisement


সমকাল : বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান পদ থেকে বহিষ্কার করার বিষয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

শওকত মাহমুদ : একটা ভুল বোঝাবুঝির মধ্য দিয়ে ঘটনাটি ঘটেছে বলে আমার মনে হয়েছে। গত বছর এপ্রিল মাসে একটি পেশাজীবী সংগঠনের ব্যাপারে অনুষ্ঠান করেছিলাম। সে অনুষ্ঠানে বলেছিলাম, দেশে যদি গণঅভ্যুত্থান করতে হয়, সেটা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে করতে হবে এবং পেশাজীবীরা এতে সহযোগিতা করবেন। এ ভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতে দল শোকজ করে একটি ব্যাখ্যা তলব করেছিল। আমি ব্যাখ্যাটা দিয়েছিলাম। এর পর দল থেকে আমাকে হ্যাঁ বা না বলে কোনো জবাব দেওয়া হয়নি। পরে আমি একটি নতুন সংগঠন করেছি। ২০১২ সালে ‘জাতীয় ইনসাফ কায়েম কমিটি’, ইংরেজিতে যাকে ‘ন্যাশনাল কমিটি ফর সিভিল রাইটস’ বলে। তখন খালেদা জিয়াও অনুপ্রাণিত করেছিলেন। ২০১৩ ও ’১৪ সালে রাজপথে কর্মসূচি পালন করেছি। কবি ফরহাদ মজহার এ সংগঠনের আহ্বায়ক এবং আমি সদস্য সচিব ছিলাম। মাঝে সংগঠনটি নিষ্ক্রিয় ছিল। এখন আবার সক্রিয় হচ্ছি। মনে হতে পারে, এটি বিএনপির একটি সমান্তরাল দল। বিএনপি ভেঙে নতুন কোনো রাজনৈতিক দল গঠন করা হচ্ছে– এ রকম ধারণা থেকে এ ঘটনাটি ঘটেছে। ইনসাফ কায়েম কমিটির অনুষ্ঠানের আগেই আমরা প্রকাশ্যে মিডিয়ার সামনে বলে দিয়েছি, এটি কোনো রাজনৈতিক দল নয়। আর কোনো দল গঠনের অভিপ্রায়ও আমার নেই। এমনকি রাজনৈতিক কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যেও নেই। আমরা নাগরিকদের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে একটি ভাবনা পেশ করলাম এবং তাদের বিবেচনার জন্য আমরা আহ্বান করলাম। আমরা বলেছি, তরুণদের প্রশিক্ষণ ও সচেতন করাই আমাদের কাজ। ফ্যাসিবাদ-বিরোধিতা যেহেতু একটি জাতীয় সংগ্রাম; সেই সংগ্রামে আমরা ভূমিকা রাখতে চাই। এটাই আমাদের লক্ষ্য। আমার পরিষ্কার বক্তব্য– এটা কোনো রাজনৈতিক দল নয়।

Advertisement

সমকাল : বিএনপির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে আপনাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু কী অভিযোগ– তা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়নি। আপনার ধারণা কী?

শওকত মাহমুদ : হ্যাঁ, সুনির্দিষ্টভাবে কোনো অভিযোগ স্পষ্ট করেনি। এর আগে শোকজেও সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ করা হয়নি। যেটা মনে হয়েছে, ইনসাফ কায়েম কমিটি গঠন বা ঘোষণার কারণে সম্ভবত এটা করেছে। কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এটা করা হয়নি। আমাদের দাবির সঙ্গে বিএনপির দাবির কোনো অসংগতি নেই। বরং আমরা এক ধাপ এগিয়ে বলেছি, নির্বাচনকালীন সব দলকে নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকার চাই, যাতে জাতীয় সরকারটি একটি শক্তিশালী সরকার হয়।

সমকাল : বিএনপি তো নির্বাচনকালীন ‘নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ চায়। আপনাদের ‘জাতীয় সরকার’-এর ধারণা তো তাদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে গেছে।

শওকত মাহমুদ: বিএনপির প্রাথমিক অবস্থান ছিল– ছোট-বড় সব দলকে নিয়েই জাতীয় সরকার গঠন করা। আন্দোলনের ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করলে দেখবেন, ছোট দলগুলো রাষ্ট্র মেরামতের দাবিও জানিয়েছিল। এটা তারা যুক্ত করেছে এবং তারা বলেছিল জাতীয় সরকার গঠন করার কথা। আমরা নাগরিকরা মনে করি, জাতীয় সরকারটা বিএনপি বলেছিল নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর সবাইকে নিয়ে গঠন করবে। যেটা শেখ হাসিনা মহাজোট গঠন করেছিলেন, সে রকম একটি সরকার। আমরা মনে করেছি, নির্বাচনের আগে জাতীয় সরকার হলে এটি নির্বাচিত সরকারের চেয়েও শক্তিশালী হবে। পার্থক্য হচ্ছে, বিএনপি একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায় এবং আমরা জাতীয় সরকারের কথা বলছি। আমরা মনে করি, রাজনৈতিক দলগুলো গণঅভ্যুত্থানের পর যদি মনে করে, জাতীয় সরকার প্রয়োজন নেই– এটা তাদের ব্যাপার। নাগরিকদের পক্ষ থেকে একটি ভাবনা পেশ করার অধিকার তো আমাদের রয়েছে।

Advertisement

সমকাল : বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনিও কিছু বলতে চাননি। অবশ্য নাম প্রকাশ না করে বিএনপির কয়েকজন নেতা বলেছেন, আপনি বিএনপির ভেতর বিভেদ ও দলের শীর্ষ নেতাদের মাইনাস এবং কিছু নেতাকে ভাগিয়ে নির্বাচনে নেওয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন।

শওকত মাহমুদ : দেখুন, এ বিষয়ে সরকারের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। আমার বিরুদ্ধে অর্ধশতাধিক মামলা রয়েছে। সপ্তাহে কমপক্ষে চার দিন আদালতে হাজিরা দিতে হয়। সরকারের সঙ্গে কোনো ধরনের সমঝোতা ও সংলাপ নেই। আমাকে বহিষ্কারের জন্য একটি গ্রুপ সক্রিয় ছিল। হয়তো তারা এসব অভিযোগ ছড়িয়েছে। এপ্রিল মাসে শোকজ করার পর অঘোষিত বহিষ্কৃত ছিলাম। বিএনপি সমর্থিত পেশাজীবী পরিষদের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক ছিলাম। অথচ কমিটি পরিবর্তন করা হয়েছে; সম্মেলনে আমাকে আমন্ত্রণও জানানো হয়নি। বিভাগীয় গণসমাবেশের মঞ্চে না উঠতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিএনপির কোনো কর্মসূচিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। আমাকে এক ধরনের এড়িয়ে চলা হয়েছে। আমি  নিশ্চিত ভেবেছিলাম, যেহেতু শোকজের জবাবের উত্তর দল দেয়নি; এটা আমার বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র হতে পারে। কিন্তু সরকারের পক্ষে গিয়ে কাজ করার অভিযোগ সম্পূর্ণভাবে অমূলক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

সমকাল : আপনি যে কয়েকটি সংগঠনের ব্যানারে নানা কর্মসূচি পালন করেছেন;  এগুলো করার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী ছিল?

সমকাল: পেশাজীবী সংগঠনের ব্যানারের ওইসব কর্মসূচিতে আমরা বারবার গণঅভ্যুত্থানের কথা বলেছি। কারণ প্রতিটি বিরোধী রাজনৈতিক দল গণঅভ্যুত্থানের ব্যাপারে দেশবাসীর কাছে অঙ্গীকার করেছে। আমরা সেই কথাটিই জোরেশোরে বলতে চেয়েছি। আমরা সহায়ক ভূমিকা পালন করতে চেয়েছি। এর মানে এই নয়– কারও পক্ষ হয়ে সরকারকে সুবিধা করে দেওয়ার জন্য আন্দোলন করছি। আর আন্দোলনের কথা বলে যদি শাস্তি পেতে হয়, তা তো দুঃখজনক। আমরা চাই, বিএনপি গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করুক। এই ক্রান্তিলগ্নে আমার মনে হয়, দলের মধ্যে হয়তো কেউ কেউ আছেন, তাঁরা আমার এই বহিষ্কারের সঙ্গে ভবিষ্যতের রাজনীতির প্রশ্নই জড়িয়ে ফেলছেন। দল যদি গণঅভ্যুত্থানের পথে হাঁটে, আমরা তো সবার আগে থাকব।

সমকাল : একজন নেতা যখন একটি রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকেন, তখন তাঁকে দলের ‘চেইন অব কমান্ড’, নীতি ও আদর্শ মেনে চলতে হয়। দলের অন্য কোনো ভাইস চেয়ারম্যান বা নেতা পৃথকভাবে কোনো সংগঠনের মাধ্যমে কর্মসূচি পালন না করলেও আপনি কেন ঝুঁকি নিলেন?

শওকত মাহমুদ : দলের বাইরে আমরা অনেক ধরনের সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। সাংবাদিক সমাজ ঐতিহ্যগতভাবে বিদ্রোহী ভূমিকা পালন করেছে। এমনকি কবি নজরুল ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন সাংবাদিকতা করেছেন, তাঁরাও বিদ্রোহী ভূমিকা পালন করেছেন। দেশে যখন স্বাধীন সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে সরকার নিপীড়ন চালিয়েছে, তখন থেকে আমরা সোচ্চার হয়েছি। জাতীয় দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে আমরা নিশ্চুপ থাকতে পারি না। আমি দলকে দেওয়া ব্যাখ্যায়ও বলেছি, পেশাজীবী হিসেবে দলের বাইরে এ ধরনের কাজ শৃঙ্খলার পরিপন্থি হলে আমি দুঃখিত। দলের আদর্শ, গঠনতন্ত্র এবং শহীদ জিয়া, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের চিন্তাধারার প্রতি আমার আনুগত্য, মুগ্ধতা এবং মান্যতা নিরঙ্কুশ ও প্রশ্নাতীত। কিন্তু আমার সেই দুঃখ প্রকাশে দল কোনো জবাব দেয়নি। প্রকৃতভাবে মামলা ও দুঃশাসন থেকে মুক্ত হওয়ার তাগিদ থেকেই নাগরিকদের মধ্য থেকে আমরা কিছু বলতে চাচ্ছি।

সমকাল : দেশের বাইরে বিভিন্ন দেশে বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের নেতাদের নিয়ে গোপন বৈঠক করেছেন বলে অভিযোগ আছে। সত্যি হলে এসব বৈঠকের উদ্দেশ্য কী ছিল?

Advertisement

শওকত মাহমুদ : ইউটিউবের মাধ্যমে এসব অভিযোগ করা হয়েছে। আমি যুক্তরাষ্ট্রে কিছুকাল লেখাপড়া করেছি। সেখানে বিভিন্ন পর্যায়ে বন্ধুবান্ধব আছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা তাঁদের দায়িত্বে বিদেশে গেছেন। কিন্তু আমি উদ্যোগ নিইনি। বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছি– এমনটি নয়। যাঁরা বিদেশে গেছেন, তাঁরা কোনো ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। সবাই মনে করেন, আমাদের দলের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সে অবস্থান নেই, যেটা সরকারি দলের আছে। সে জন্য দেশের বাইরে দেশের দুঃশাসনের কথাগুলো তুলে ধরতে তাঁরা হয়তো সহায়ক ভূমিকা পালন করেছেন। এর বাইরে কিছু নয়। কারা গেছেন, আমি জানি না। আমার প্রতি অভিযোগের আঙুল তোলাটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

সমকাল : অনেকে মনে করেন, দলীয় পদে থেকেও পৃথকভাবে নানা কর্মসূচি পালন করায় আপনার সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের একটা দূরত্বও তৈরি হয়েছে।

শওকত মাহমুদ : বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে আমি ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছি। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে সম্পর্ক আছে। তবে ইদানীং আমাদের মধ্যে যোগাযোগ নেই বললেই চলে। তবে আমি মনে করি না, এই সাময়িক দূরত্বের কারণে এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আমার বিষয়ে দলের স্থায়ী কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নিলেও তা ভুল করতে পারে। আমি আশা করি যথাসময়ে এটা সংশোধন করবে।

সমকাল : সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

শওকত মাহমুদ : সমকালকেও ধন্যবাদ।