তারেকের সঙ্গে মেন্দি সাফাদির কথোপকথনের ভিডিও ফাঁস

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),আন্তর্জাতিক প্রতিনিধি, শনিবার, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ : ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের এজেন্ট মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে বিএনপির এক নেতার কথোপকথনের নতুন একটি চাঞ্চল্যকর ভিডিও পাওয়া গেছে। ভিডিওতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে উদ্দেশ করে কথা বলতে দেখা গেছে মেন্দিকে। তার পেছনে দাঁড়ানো বিএনপির কৃষি বিষয়ক সহসম্পাদক ও তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ কৃষিবিদ চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল ফারুক ও বিএনপিপন্থি সাংবাদিক মামুন স্ট্যালিন। বিশ্লেষকরা বলছেন, এতে বোঝা যাচ্ছে তারেক রহমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রয়েছে এই ইসরাইলি গোয়েন্দার।

Advertisement

আর এর পেছনে বড় কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক তন্ময় আহমেদ। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে তারা মেন্দির সঙ্গে কাজ করছেন। তাদের কলকাঠি নাড়ছেন তারেক রহমান।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য সাইরুল কবির খান বলেন, ‘প্রথমত আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নেই। আর এগুলো নিয়ে আমি জানিও না। এই ভিডিওর সত্যতা নিয়ে আমি কিছু বলতে পারব না।’

এ নিয়ে বিএনপির দলীয় বক্তব্য থাকবে কি না; জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দলীয় বক্তব্য যখন নেতারা দেবেন; তখন জানতে পারব। আগে তারা বক্তব্য দিক, তখন বলা যাবে।’

এরআগে বিএনপি নেতা আসলাম চৌধুরী ও গণঅধিকার পরিষদের সদস্যসচিব নুরুল হক নুরও ইসরাইলের ক্ষমতাসীন দল লিকুদ পার্টির এই সদস্যের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

Advertisement

সম্প্রতি পাওয়া ভিডিওতে তারেক রহমানকে উদ্দেশ করে সাফাদিকে বলতে শোনা যায়, ‘শুভ সকাল তারেক রহমান। আমি মেন্দি। আপনার প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। আমরা বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছি। আমি মনে করি, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা নিয়ে আমি কাজ করছি। যেসব তথ্য আমি চেয়েছি এবং যেগুলো পেয়েছি; সব বিষয়েই আমাদের আলোচনা হয়েছে। আমাদের মিশন সম্পর্কে কথা হয়েছে।’

তারেক রহমানকে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে সাফাদি বলেন, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, আমার পেছনে যে টিম রয়েছে, তারা আমাদের মিশন সফল করার জন্য কাজ করছে। এ টিম বাংলাদেশের মানুষের মুক্ত জীবন ও গণতন্ত্র নিশ্চিত করবে।’

তারেক রহমানকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনারও আশ্বাস দিয়েছেন মেন্দি সাফাদি। তিনি বলেন, ‘আমি আশা করি, এ টিম আপনাকে বাংলাদেশের নেতা হিসেবেও প্রত্যাবর্তন করাবে।’

Advertisement


এছাড়া দেশে দণ্ডিত হয়ে লন্ডনে পলাতক তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাতের প্রত্যাশা ব্যক্ত করে সাফাদি বলেন, ‘ধন্যবাদ। আশা করি, আপনার সঙ্গে খুব শিগগিরই লন্ডনে দেখা হবে।’

এই ভিডিওটি কবে ধারণ  করা হয়েছে সে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। আওয়ামী লীগের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) সমন্বয়ক তন্ময় আহমেদ সময় সংবাদকে বলেন, ‘মেন্দি যখন তারেক রহমানের সঙ্গে কথা বলছিল, তখন সামনে দাঁড়িয়ে কেউ ভিডিও করেছে। তাদের চক্রের লোকজনই এই ভিডিও ফাঁস করেছেন। নাহলে এটা কখনোই আমাদের পাওয়ার কথা না। ভিডিও পাওয়ার পর, সেটির সত্যতাও আমরা নিশ্চিত করেছি।’

মেন্দির সঙ্গে তারেক রহমানের যোগাযোগের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তারা ইসরাইলি কানেকশনের মাধ্যমে পশ্চিমা দেশগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ দেয়াতে চান। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কথা বলাতে চাচ্ছেন। তারা মূলত বিএনপির এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছেন।’

সরকারকে চাপে রাখতে তারা ইসরাইলি গোয়েন্দাদের ব্যবহার করছে জানিয়ে তন্ময় আহমেদ বলেন, ‘তারেককে উদ্দেশ করে মেন্দি কথা বলছেন। এটি কোনো তুচ্ছ বিষয় না, অনেক বড় বিষয়। সেভাবেই গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত।’

সম্প্রতি ফেসবুকে দেয়া এক পোস্টে তন্ময় বলেন, ‘ভিডিওতে মেন্দি খুব হাস্যোজ্জ্বল মুখে কোনো একজন বিগ শটের সাথে ভিডিও কলে কথা বলছেন। পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন বিএনপির বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির একজন নেতা। এখন তার বেশভূষা পরিবর্তন হয়েছে। তিনি বিশাল আকৃতির দাড়িও রেখেছেন এবং বিএনপির বিভিন্ন প্রোগ্রামে বক্তৃতাও দিয়ে থাকেন। তার নাম কৃষিবিদ চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-ফারুক।’

বিএনপির এই নেতাকে নিয়ে তথ্য দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘চৌধুরী ফারুক কেন্দ্রীয় বিএনপির কৃষি বিষয়ক সহসম্পাদক। বর্তমানে তিনি নেত্রকোনা ৪ থেকে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী। এছাড়াও তারেক রহমানের খুবই ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত তিনি। তারেকের হয়ে বিদেশি এজেন্টের সাথে ঘনিষ্ঠতা বজায় রাখেন।’

তন্ময় বলেন, ‘জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশনে জড়িত থাকা চৌধুরী ফারুক পেশাজীবীদের সাথে বিএনপির হয়ে সম্পর্ক রক্ষা করার দায়িত্বও পালন করেন। এটি তার আরেকটি বড় দায়িত্ব। এছাড়াও সেমিনারে অংশগ্রহণের নামে বিদেশে ভ্রমণ করে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখেন তিনি। এভাবেই মেন্দি সাফাদির সঙ্গে তার পরিচয় ও সম্পর্ক গড়ে ওঠে।’

আসলাম চৌধুরীর পর নুর
এরআগে মোসাদের এই এজেন্টের সঙ্গে বৈঠক করার অভিযোগ ওঠে গণঅধিকার পরিষদের সদস্যসচিব নুরুল হক নুরের বিরুদ্ধে। সামাজিকমাধ্যম ফেসবুকে এমন একটি ছবি ভাইরাল হয়েছে। এছাড়া দেশের বাইরে গিয়ে উসকানিমূলক বক্তব্য দেয়ায় নুরকে গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনার দাবি উঠেছিল তখন। তবে এ সবই ‘প্রোপাগান্ডা’ দাবি করে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন নুর।

তন্ময় বলেন, ‘বিএনপি নেতা আসলামের কথা মনে আছে, যে কি না ইসরাইলের লিকুদ পার্টির নেতা মেন্দি সাফাদির সাথে ভারতে দেখা করেছিল এবং মোসাদ নাকি বিএনপিকে এদেশে ক্ষমতায় বসাবে!! তারপর অনেক ইতিহাস।’

গেল ডিসেম্বরের শেষভাগে কাতারে যান নুর। সেখান থেকে দুবাইয়ে গিয়ে কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে বৈঠক করেন। তিনি দুবাই থেকে সৌদি আরবে যান। এরমধ্যেই সাফাদির সঙ্গে তার বৈঠক হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

সাফাদির সঙ্গে বৈঠক করে গ্রেফতার হয়েছিলেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির তৎকালীন আহ্বায়ক আসলাম চৌধুরী। সাফাদির সঙ্গে তার হাসিমুখে কয়েকটি ছবি গণমাধ্যমে ফাঁস হয়। সে সময় বিষয়টি তুমুল আলোচনার জন্ম দেয়।

আসলামের পক্ষে সাফাই গেয়ে নুর তখন বলেন, ‘বিএনপি একটি বড় রাজনৈতিক দল, যারা একাধিকবার রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল। তাদের দলের একজন নেতার সঙ্গে বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থার বৈঠক হতেই পারে। কিন্তু সেই কারণে সরকার তাকে গ্রেফতার করতে পারে না। আমি বলব, বিএনপিও এ বিষয়টি নিয়ে নীরব ভূমিকা পালন করেছিল, এটি বিএনপির উচিত হয়নি। আসলাম চৌধুরী তাদের একজন নেতা, তার পক্ষে তাদের দাঁড়ানো উচিত ছিল।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী এবং বিশ্লেষকদের মতে, মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে বৈঠক করে নুরুল হক নুর ফিলিস্তিনিদের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসায় আঘাত করেছেন। অনেকের মতে, নির্বাচন সামনে রেখে সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে নুর এ বৈঠক করেন।

তদন্তের দাবি সংসদে
এদিকে সাফাদির সঙ্গে ভিপি নুরের বৈঠকের বিষয়ে যথাযথ তদন্তের দাবি উঠেছে জাতীয় সংসদে। গেল ৯ জানুয়ারি সংসদ অধিবেশনে কয়েকজন সদস্য এই দাবি তোলেন। একই সঙ্গে বিষয়টি তদন্ত করে সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি দাবি করা হয়েছে।

জাতীয় পার্টির সদস্য পীর ফজলুর রহমান সংসদে বলেন, ‘নুর কারও সঙ্গে বৈঠক করতেই পারেন। কিন্তু যে দেশের সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই, যে ইসরাইল ফিলিস্তিনি নারী-শিশুকে হত্যা করছে, সেই দেশের গোয়েন্দা সদস্যের সঙ্গে বৈঠক আইনসম্মত নয়। এ বিষয়ে তদন্ত করে সংসদে ৩০০ বিধিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি দাবি করছি।’

সাফাদি সম্পর্কে যা বলছেন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূত
ঢাকায় নিযুক্ত ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত ইউসুফ এস ওয়াই রামাদান বলেন, ‘তার নাম মেন্দি সাফাদি না, তার আসল নাম মুনজের সাফাদি। তিনি গুলেন হায়েস্তের একজন সিরীয়। ওই জায়গাটা ১৯৬৭ সালে ইসরাইল দখল করে নেয়।’

‘মোসাদে যোগ দেয়ার কারণে মেন্দি সাফাদিকে তার বাবা-মা ও ভাই-বোনও তাকে ছেড়ে চলে যায়। কারণ তিনি নিজের পরিবারের সম্মানহানি করেছেন। এতে গুলেন হায়েস্ত ছেড়ে তেল-আবিবে চলে যেতে হয় তাকে।’

রামাদান একটি গণমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব লাভের পর থেকে ফিলিস্তিনকে সমর্থন করে এসেছে। অন্যদিকে একজন ‘গণতন্ত্রকামী’ নেতা হিসেবে নুরের এমন আচরণ বাংলাদেশের ৯০ ভাগ জনগণের মতের বিরুদ্ধে যায়। এই ৯০ শতাংশ মানুষের ইচ্ছার বাইরে গিয়ে কেউ তো গণতন্ত্রের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে করতে পারবে না।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান (বামে) ও মোসাদের এজেন্ট মেন্দি এন সাফাদি (ডানে)।