১৭ বছর কবিরাজি করেও শেষ রক্ষা হলো না,খুনের মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হিসাবে গ্রেফতার

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),ঢাকা প্রতিনিধি,বৃহস্পতিবার , ২৭ অক্টোবর ২০২২ : হেমায়েত ওরফে জাহিদ। চাঞ্চল্যকর খুনের মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। তবে এ দণ্ড থেকে নিজেকে আড়াল করতে দীর্ঘ ১৭ বছর ছদ্মবেশে ঘোরাফেরা করে। করেছে কবিরাজি। তবে তার শেষ রক্ষা হলো না। অবশেষে গ্রেপ্তার হতে হয়েছে র‌্যাবের কাছে।

বৃহস্পতিবার (২৭ অক্টোবর) দুপুরে কাওরান বাজার র‍্যাবের মিডিয়া সেন্টারের সংবাদ সম্মেলনে আইন ও গণমাধ্যম শাখার প্রধান কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, বুধবার (২৬ অক্টোবর) রাতে মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে জাহিদকে গ্রেপ্তার করা হয়। উদ্ধার করা হয় কবিরাজি চিকিৎসায় ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের আংটি ১২৯টি, বক্স ১টি, শঙ্খ ৩টি, আলাদীনের কথিত চেরাগ ১টি, ক্রেস্ট ২টি, কবিরাজি সংক্রান্ত বই ১৫টি।

তিনি বলেন, জাহিদ ১৫-১৬ বছর বয়স থেকে কবিরাজি পেশা শুরু করে। কবিরাজির পেশার মাধ্যমে সে নানাভাবে মানুষকে প্রতারিত করে অর্থ উপার্জন করত। তার বাবা কবিরাজি পেশায় থাকায় সে তার বাবার কাছ থেকে বিভিন্ন পদ্ধতি ও কৌশল শেখে। মূলত নারীরাই ছিল তার প্রতারণার মূল টার্গেট। ২০০৩ সালে সে তার স্ত্রী সন্তানসহ পিরোজপুর থেকে বাগেরহাটে এসে কবিরাজি ব্যবসা শুরু করে। কবিরাজি পেশায় তার অন্যতম সহযোগী ছিল হত্যা মামলার অপর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি সোবহান। ২০০৫ সালে জানুয়ারি মাসে সোবহান মনুকে মাথাব্যথার রোগকে মানসিক রোগ বলে আখ্যায়িত করে কবিরাজি চিকিৎসার জন্য জাহিদের কাছে নিয়ে আসে। মনুর স্বামী ঢাকায় চাকরি করত এবং প্রতিমাসে সংসারের খরচ চালানোর জন্য মনুর কাছে টাকা পাঠাত। মনু তার জমানো টাকা দিয়ে কাপড়ের ব্যবসা করত এবং নারী উদ্যোক্তা হয়ে ওঠেন। কাপড়ের ব্যবসা করে এবং স্বামীর পাঠানো টাকা জমিয়ে মনুর কাছে লাখ টাকা জমা হয়।

সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেন, এই অর্থের প্রতি জাহিদের লোলুপ দৃষ্টি পড়ে। সে মনুর সরলতার সুযোগে তার টাকা পয়সা হাতিয়ে নেওয়ার টার্গেট করে। জাহিদ মনুকে কিছু ভেষজ উপাদানের মাধ্যমে নিয়মিত ঘুমের চিকিৎসা দেওয়া শুরু করে। একপর্যায়ে মনুকে তার যাবতীয় সম্পত্তির দলিলপত্র এবং টাকা পয়সা শত্রুপক্ষের জ্বিনের আক্রমণে পড়তে পারে বলে ভয়ভীতি দেখিয়ে জমা রাখতে উদ্বুদ্ধ করে।

নিয়মিত ভেষজ উপাদান সেবনের ফলে মনুর ঘুম হয় এবং মাথাব্যথার প্রবণতা কিছুটা কমে আসলে জাহিদের ওপর মনুর আস্থা তৈরি হয়। মনু সরল বিশ্বাসে তার টাকা পয়সা ও সম্পত্তির দলিল জাহিদের কাছে জমা রাখে। মনুর বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী জাহিদ সহযোগীসহ তাকে চেতনানাশক ওষুধ খাইয়ে দলিলপত্রে টিপ সই নিয়ে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার চেষ্টা করে।

একপর্যায়ে মনুর জ্ঞান ফিরে আসলে সে পুলিশের কাছে গিয়ে অভিযোগ করার জন্য উদ্ধত হলে মনুর সাথে ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে সহযোগীর সহযোগিতায় জাহিদ মনুকে কুপিয়ে এবং গলা কেটে হত্যা নিশ্চিত করে। এরপর রাতের অন্ধকারে মনুর গলাকাটা লাশ বস্তাবন্দী করে জাহিদের বাড়ির সামনের খালের অপর পাশে ধানক্ষেতে লুকিয়ে রাখে।

২০০৫ সালে হত্যাকাণ্ডের পর বাগেরহাট সদর থানায় হত্যা মামলা দায়েরের খবর পেয়ে সে বাগেরহাট থেকে পালিয়ে যশোরে একটি মাজারে আশ্রয় নেয়।  অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে আজমির শরীফ মাজারের উদ্দেশে রওয়ানা করে জাহিদ। সেখানে সে কবিরাজি পেশাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে ৩ বছর অবস্থান করে। ২০০৮ সালে পুনরায় অবৈধ পথে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে ফিরে এসে ঢাকার মিরপুরে বসবাস শুরু করে। এসময় সে নিজের আসল পরিচয় গোপন করার জন্য লম্বা চুল ও দাড়িওয়ালা ছবি ব্যবহার করে তার নাম ও স্থায়ী ঠিকানা পরিবর্তন করে মো. জাহিদুল ইসলাম ছদ্মনাম ব্যবহার করে একটি এনআইডি কার্ড তৈরি করে। সে বিভিন্ন সময়ে একাধিক বিয়ে করে।

মিরপুরে থাকাকালে জাহিদ পুরনো পেশা কবিরাজির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারণা করতে থাকে। সে মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের তাবিজ, স্বামী-স্ত্রীর কলহ দূরীকরণ তাবিজ, বশীকরণ তাবিজ ইত্যাদির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বড় অংকের টাকা নিয়ে প্রতারণা করত।

র‌্যাব জানায়, মিরপুরে ৩ বছর অবস্থানের পর তার প্রতারণার বিরুদ্ধে জনরোষ সৃষ্টি হলে সে ঠিকানা পরিবর্তন করে কিছুদিন আদাবর, কেরানীগঞ্জ এবং সর্বশেষ বিগত ৫ বছর যাবত মোহাম্মদপুর বসিলায় বিভিন্ন স্থানে বসবাস করছে। বসিলায় একইভাবে সে কবিরাজি ব্যবসা করতে থাকে। তাবিজ দেওয়ার পাশাপাশি উপরন্তু এখানে সে তার বশবর্তী জ্বিনের বাদশার মাধ্যমে মানুষের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের কথা বলে নতুনভাবে প্রতারণার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়।

মূলত সে নারীদের টার্গেট করে জ্বিনের বাদশার মাধ্যমে নারীদের বিভিন্ন শারীরিক, মানসিক, আর্থিক ও পারিবারিক সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে দীর্ঘদিন যাবত কবিরাজি ব্যবসা চালিয়ে আসছে। ২০১২ সালে দারুস সালাম থানায় মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে তার বিরুদ্ধে একটি মামলা রয়েছে। এ ছাড়াও ২০১৭ সালে সে তার কবিরাজি কাজে ব্যবহৃত কষ্টি পাথরের মূর্তি রাখার দায়ে চোরাকারবারি হিসেবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেপ্তার করে। দেড় মাস হাজতবাসও করে সে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য সে বারবার অবস্থান পরিবর্তন করে থাকে। গত দুই মাসের মধ্যে সে কিছুদিন পর পর পিরোজপুর, যাত্রাবাড়ী, মোহাম্মদপুর, কেরানীগঞ্জ এবং মিরপুরে তার অবস্থান পরিবর্তন করেছে। তার পরিচয় গোপন রাখার জন্য সে মাঝে মাঝে চুল, দাড়ির রং পরিবর্তন, পোশাকের ধরণ পরিবর্তন করেছে।