চাঁদপুরে শুরু হয়েছে ল্যাংটা পাগলের মেলা

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),মতলব প্রতিনিধি,শুক্রবার, ০১ এপ্রিল ২০২২ : প্রতি বছরের মতো বৃহস্পতিবার থেকে পরবর্তী ৭ দিনব্যাপী শুরু হয়েছে চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার সাদুল্যাপুর ইউনিয়নের বদরপুরের বেলতলীতে সপ্তাহব্যাপী হযরত শাহ্ সোলেমান লেংটা পাগলের মেলা।

ল্যাংটা পাগলের মেলায় এসে সোলেমান শাহ ল্যাংটার অনুকরণ করছে তার ভক্তরা। গতকাল থেকে শুরু হয়ে  আগামী ৫ এপ্রিল মঙ্গলবার পর্যন্ত চলবে এ মেলা। এবার পালিত হচ্ছে শাহ্ সোলেমান লেংটার ১০৩তম ওরশ শরীফ। মেলায় প্রতিদিন লক্ষাধিক লোকের সমাগম ঘটে এবং বিগত বছরগুলোর মতো এবারও এই মেলা যেন মাদকের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে এমন দৃশ্য বৃহস্পতিবার সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে।

শাহ্ সোলেমান লেংটার ওফাত দিবস উপলক্ষে গত ১০৩ টি বছর যাবত উদযাপিত হয়ে আসছে সাত দিনব্যাপী মেলা। স্থানীয়দের মতে বেলতলীর বদরপুর গ্রামে সোলেমান শাহ্ নামে এক ফকিরের মাজার আছে। এই মাজারই ল্যাংটা ফকিরের মাজার হিসেবে পরিচিত। কথিত আছে, সোলেমান শাহ্ জীবদ্দশায় একটুকরো কাপড় দিয়ে লজ্জাস্থান ডেকে রাখতো বলে, তাকে লেংটা পাগল ডাকতো সবাই। প্রতি বছর এ অসংখ্য বক্তরাই লেংটার মেলার আয়োজন করে থাকেন। প্রতি বছর ৩১ মার্চ শুরু হয়ে এ মেলা, শেষ হয় ৫ এপ্রিল।

নামে লেংটা হলেও আদতে এখানে আশা পাগলেরা কেউই লেংটা নন। তবে তারা ভাবের পাগল। শাহ্ সোলেমান শাহ্ জন্মস্থান কুমিল্লা জেলার বর্তমান মেঘনা থানার গোবিন্দপুর ইউনিয়নের আলীপুর গ্রামে। তার বাবার নাম আলা বঙ্গ ভূঁইয়া।  তার জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন মতলবের বদরপুরের এ বেলতলীর তার বোনের বাড়িতে। সেখানে থেকে নারায়ণগঞ্জের বক্তাবলী গ্রামে তিনি বিয়ে করেন। অনেকেই দাবি করেন তার বংশধর এখনও আছে। সোলেমান শাহ্ কাউকে মুরিদ করেননি। তবে  মতলব তথা দেশের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে তার ব্যাপক পরিচিতি ও অগণিত ভক্ত। প্রতিবছর অগণিত ভক্ত এ ল্যাংটা মেলার আয়োজন করে থাকে। বাংলা ১৩২৫ সালের ১৭ চৈত্র সোলেমান শাহ বেলতর্লী বদরপুর তার বোনের বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ১৮ চৈত্র তাকে বদপুরের এই বেলতলীতে (যেখানে মাজার) সেখানে তাকে দাফন করা হয় বলে মাজার পরিচালনায় দায়িত্বে থাকা খাদেম মো. দেলোয়ার হোসেন মোল্লা জানান। তারপর ভক্তরা তার বোনের বাড়িতে মাজার প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকেই শুরু হয়ে যায় সপ্তাহ ব্যাপী লেংটা পাগলের মেলা। যদিও তার মৃত্যু তারিখের দু’একদিন আগে পড়ে এখানেই ৭ দিন ব্যাপী ওরশ হতো। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ছোট-বড় লঞ্চ, ট্রলার, বাস, মিনি বাস, ট্রাক, মেক্সী, প্রাইভেটকার,সিএনজি,অটোবাইক যোগে ওরশে আসে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ লাখ মানুষ। তাঁরা নিয়ে আসেন গরু, মহিষ, ছাগল, মোরগ, ডিম, ডাল, চাউল, নগদ অর্থসহ বিভিন্ন মানতি জিনিসপত্র। ল্যাংটার মেলায় একদিকে আনন্দের হিল্লোল অন্যদিকে বসে গাঁজার রমরমা আসর। অনুসন্ধানী চোখে তাকালেই দেখা যায়, দলে দলে ভাগ হয়ে গাঁজা টানছে পাগলের ক্ষুদ ক্ষদ্র্র দল। তবে এ ব্যাপারে প্রশাসন নিরব ভুমিকা পালন করে। গতকাল বুধবার থেকেই ল্যাংটার ভক্ত আশেকানরা আস্তানা নিয়ে বসে গেছে।

আর এই মেলাকে ঘিরে ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা  পকেটমার, ছিনতাই, মলমপার্টি, হিজরা, প্রতারকদের তৎপরতা বেড়ে যায়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ভক্তরা লেংটা বাবার দরবারে পুণ্য, রোগমুক্তিসহ বিভিন্ন কামনা-বাসনা নিয়ে আসেন। এছাড়াও ঢোল-কারার মাধ্যমে বাবার উদ্দেশ্যে ধর্মীয় গান ও মজমা বসায় পুন্যের আশায়।

৭ দিনের এ মেলায় আগত দোকান থেকে অনুপাতে ৫ থেকে ১০/২০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়। মাজারে মানতে দেয়া হচ্ছে- গরু, ছাগল, নগদ অর্থ, আগরবাতি ও মোমবাতি। মাজারে প্রতিদিন উঠছে কয়েক লাখ টাকা। সব মিলে এখানে বাণিজ্য হচ্ছে কয়েক কোটি টাকা। মাজার কমিটি প্রতিবছর ভাল অংকের টাকাও উপার্জন করে থাকে। আর এ মাজারে দেয়া মানতি টাকা কতিপয় কয়েকজনের পকেটে। এ টাকার কোনো রাজস্ব পাচ্ছে না সরকার। এ টাকায় অনেকেই আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছে। সারা বছর এ মাজারটি অর্থ পাওয়ার সেক্টরে পরিণত হয়েছে। দোকান বসে প্রায় ৫ সহস্রাধিক। মেলা চলাকালীন ছোট দোকানে ভাড়া দিচ্ছে ১ সপ্তাহের জন্য ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। মিষ্টির দোকান ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা, খেলনার দোকান ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। এমনিভাবে অসংখ্য টাকা উঠছে মেলা উপলক্ষে।

এছাড়া অসংখ্য ভক্ত রয়েছেন তারা ল্যাংটা বাবার মাজার জিয়ারত করছেন এবং জিকির আসকার করে ঢোল বাদ্য, বাজনা বাজিয়ে মাজার ত্যাগ করছেন। কারণ তাদের মতে, ল্যাংটা ফকির ছিলেন একজন ভালো লোক। মেলাকে ঘিরে গতকাল বৃহস্পতিবার থেকেই অসংখ্য পাগল ও ভক্তবৃন্দদের ভিড়ে মুখরিত হয়ে উঠেছে মতলবের বেলতলী।

বৃহস্পতিবার দুপুরে মেলার চতুরদিকে ঘুরে কয়েক লক্ষাধিক লোকের সমাগম ও মাদকের স্বর্গরাজ্য চিত্র দেখা যায়। অনেকে নারী-পুরুষ,স্কুল কলেজের ছেলেরা পর্যন্ত মাদক ও অশ্লীলতার মাঝে নিজেকে ডুবিয়ে রাখে। ছোটখাটো অসংখ্য আসর বসে যার বেশির ভাগ স্থানেই নারী পুরুষ অশ্লীল নৃত্যে মগ্ন থাকতে দেখা গেছে। মাজারের পশ্চিম পাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে চলছে গাঁজা সেবনের মহোৎসব। এ যেন গাঁজার স্বর্গরাজ্য নিরাপদ স্থান। যেন দেখার কেউ নেই।

লেংটার মেলায় প্রতিদিন লক্ষাধিক লোকের ভিড় ও দূর-দূরান্তে থেকে আসা অসংখ্য লোকের তত্বাবধানকরতে সমস্যা হয় কি না প্রসঙ্গে মাজারে দীর্ঘ ৪০ বছর যাবত খাদেম হিসেবে দায়িত্ব পালন করা খাদেম লাল মিয়া সরকার বলেন, প্রথম দিকে কিছুটা সমস্যা হলেও দীর্ঘদিনের অভ্যাসের কারণে এখন আর কোনো সমস্যা মনে করি না। তাছাড়া স্থানীয় লোকজন এ কাজে অনেক সহযোগীতা করে থাকেন। প্রতি বছর মেলা ৭ দিন হলেও এবার পবিত্র মাহে রমাজন মাসের কারণে একটু ছোট করা হয়েছে। মাজারের পবিত্র রক্ষা করার জন্য আমরা চাঁদপুর ও মতলব উত্তর উপজেলা প্রশাসন ও থানা প্রশাসনের কাছ থেকে সহযোগিতা চেয়েছি। তারা আমাদেরকে এই লাখ লাখ আশেকাকান ভক্তবৃন্দের সমাগম লেংটার মেলা যাতে শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। গত দুই বছর করোনা ভাইরাসের কারণে মেলা বন্ধ ছিল। এবার জেলা প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে মেলা আয়োজন চলছে।

খাদেম লাল মিয়া জানান, লাখ লাখ লোকের মিলন মেলায় আল্লাহর অশেষ মেহেরবানী আছে বিধায় প্রতিবছর শান্তিপূর্নভাবে সম্পন্ন হয়। নতুবা যে লোকের সমাগম তা প্রশাসনের একার পক্ষে সম্ভব হতো না।

মতলব উত্তর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. মাসুদ জানান, মেলা চলাকালীন সময়ে আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি যাতে সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক থাকে তার জন্য ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এ উপলক্ষ্যে গোয়েন্দা, ডিবি,এসবি, প্রয়োজনীয় সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, মেলার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ, আনছার ও কমিউনিটি এবং বিশেষ পরিস্থিতির জন্য রিজার্ভ’সহ প্রায় ২০০ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।

তিনি বলেন, ওরশের পবিত্রতা রক্ষা ও নির্ভিঘ্নে ওরশ পালন করার স্বার্থে কোনো প্রকার মাদক বিক্রি করতে দেয়া হবে না। এর সঙ্গে কারও জড়িত পাওয়া গেলে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে আমরা সর্বদা প্রস্তুত রয়েছি।