অর্থ লুটপাট হাতেনাতে ধরা পড়ার পরও পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরে বহাল-তবিয়তেই ছিলেন পরিচালক আশরাফুন্নেছা

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),ঢাকা প্রতিনিধি,০৫ এপ্রিল : সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজের সৌজন্যে: দুর্নীতি দমন কমিশন’র (দুদক) হটলাইন নাম্বার ১০৬ এ হঠাৎ একটি কল এল। অভিযোগ করা হল পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের কর্মকর্তারা ওয়ার্কশপ, সেমিনার ও প্রশিক্ষণের নামে ভুয়া বিল-ভাউচার তৈরি করে সরকারি অর্থ আত্মসাত করছে। বিষয়টি আমলে নিয়ে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরে অভিযান পরিচালনা করল দুদক। অভিযানে সত্যতা মিলল অভিযোগের, বেরিয়ে আসল অধিদফতরের কর্মকর্তাদের সরকারি অর্থ লুটপাটের চিত্র। এ যেন কেঁচো খুড়তেই সাপ! অধিদফরের কর্মকর্তারা যে যেভাবে পারছে সেভাবেই লুটে নিচ্ছে সরকারি সম্পদ। হরিলুটের মত খাবলে খামচে পকেট ভরতে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত কর্মকর্তারা। এ হরিলুুটে সবচেয়ে পকেট ভারি অধিদফতরের তথ্য, শিক্ষা ও উদ্বুদ্ধকরণ (আইইএম) ইউনিটের পরিচালক ড. আশরাফুন্নেছার। কথায় আছে রক্ষক যখন ভক্ষক হয় তখন আর কোন উপায় থাকেনা। পরিচালক পদে থেকে আইইএম ইউনিটকে লুটেপুটে খেয়ে এর বেহাল দশা করে ছেড়েছে ড. আশরাফুন্নেছা। দুদকের অভিযানে দেখা যায় নিয়োগ বানিজ্যসহ অধিদফতরের আওতাধীন বিভিন্ন প্রকল্পে ওয়ার্কশপ, সেমিনার ও প্রশিক্ষণের নামে ভুয়া ভাউচার তৈরি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। শুধু এক অর্থ বছরেই ৪৮৬টি কর্মশালার ভুয়া ভাউচার করে হাতিয়ে নিয়েছেন ৭ কোটি টাকা। আত্মীয় স্বজনকে দিয়ে ভুয়া কোম্পানীর নামে কার্যাদেশ দিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিতেন আশরাফুন্নেছা। পারিবারিক কাজে সরকারি ৩টি গাড়ি ব্যবহার করতেন তিনি। শুধু তাই নয় এসব গাড়ি মেরামতের নামে ভুয়া বিল করে ৩৪ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেন। এসব অভিযোগের বিষয়ে ড. আশরাফুন্নেছাসহ সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদও করেছিল দুদক। কিন্তু স¦াস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ও বর্তমান জনপ্রশাসন সচিব শেখ ইউসুফ হারুন (তখনকার স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগের সচিব) এর আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ায় তার বিরুদ্ধে কোন আইনি বা দাফতরিক ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়নি। দুদক টিমের অভিযান এবং হাতেনাতে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া অর্থাৎ অভিযুক্ত হওয়ার পরও স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও সচিবের সফর সঙ্গী হয়ে বিদেশ সফর করেন ড. আশরাফুন্নেছা। এ নিয়ে সর্ব মহলে ব্যাপক সমালোচনা হয়। তার দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়। কিন্তু বিষয়টি আমলে নেয়নি স্বাস্থ্যমন্ত্রী। এমনকি তিনি ড. আশরাফুন্নেছাকে চাকরির মেয়াদের শেষদিন পর্যন্ত স্বপদে বহাল থেকে লুটপাট অব্যাহত রাখার সুযোগ করে দেন।
শুধু দুদকই নয়, পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরে পরিচালক ড. আশরাফুন্নেছার নেতৃত্বে লুটপাটের চিত্র বেরিয়ে এসেছে খোদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব তদন্তেও। তারপরও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যায়নি শুধুমাত্র এই প্রভাবশালীদের বিশেষ আনুকূল্যের কারণে। গত ৩১ ডিসেম্বর চাকরির শেষদিন পর্যন্ত বহাল-তবিয়তেই ছিলেন এবং দাপটের সঙ্গে অপকর্ম করার সুযোগ পেয়েছেন পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরে।
দুদকের অভিযান ও হাতেনাতে যেভাবে দুর্নীতি-লুটপাটের তথ্যপ্রমাণ উদঘাটিত হলো
পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের তথ্য, শিক্ষা ও উদ্বুদ্ধকরণ (আইইএম) ইউনিটের পরিচালক এই আশরাফুন্নেছা দুর্নীতি-লুটপাটে এতো বেপরোয়া ছিলেন যে, তিনি এই সংস্থায় যোগদানের কিছুদিনের মাথাই সংশ্লিষ্ট সবাই তার অপকর্মের খবর জেনে যায়। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ ব্যক্তিদের ছত্রছায়ার কারণে কেউ তাকে কিছু বলার সাহস পাচ্ছিলো না। এতে তার দুর্নীতির প্রবণতা আরো বেড়ে যায়। ইতিমধ্যে তিনি পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরে দুর্নীতির একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। এক পর্যায়ে তার নেতৃত্বে এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কর্মশালার নামে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠতে থাকে। মন্ত্রণালয়েও তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ জমা পড়ে। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছিলো না। অবশেষে দুদকের হটলাইনে অভিযোগ আসে। ২৪ অক্টোবর, ২০১৯ দুর্নীতি দমন কমিশনের এনফোর্সমেন্ট টিম পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের আইইএম ইউনিটে দুর্নীতির অনুসন্ধানে অভিযান চালায়। আশরাফুন্নেছার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের অনুসন্ধানে তিন সদস্যের একটি টিম ওই অভিযান চালায়। সরকারি অর্থ বেপরোয়াভাবে লুটপাটের প্রমাণ হাতেনাতে পেয়ে যায় দুদকের টিম।
দুদকের জিজ্ঞাসাবাদ 
অবাক ব্যাপার হলো, পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরে দুর্নীতি দমন কমিশনে’র (দুদক) অভিযানে হাতেনাতে প্রমাণ অর্থাৎ প্রাথমিক অনুসন্ধানে অভিযুক্ত হওয়ার পরও দীর্ঘ এক বছর লেগে যায় দুদক ড. আশরাফুন্নেছাকে তলব করতে। বস্তুত ড. আশরাফুন্নেছার দুর্নীতির নেটওয়ার্ক অত্যন্ত শক্তিশালী। আর তাই দুদকের তদন্তও সেই পর্যায়ে অনেকটা বাধাপ্রাপ্ত হয়।
অবশেষে প্রাপ্ত তথ্যের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে অধিদফতরের কর্মকর্তাদের তলব করে ৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ একটি নোটিশ পাঠায় দুদক। এরপর ১৩ সেপ্টেম্বর দুদকের প্রধান কার্যালয়ে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের উপ-পরিচালক (পিএম) জাকিয়া আখতার ও উপ-পরিচালক (স্থানীয় সংগ্রহ) আবু তাহের মো. সানাউল্লাহ নূরীকে এবং ১৪ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত অধিদফতরের সহকারী পরিচালক এ কে এম রোকনুজ্জামান ও গবেষণা কর্মকর্তা পীযূষ কান্তি দত্তকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন সংস্থাটির উপ-পরিচালক সালাহউদ্দিন। পরদিন ১৫ সেপ্টেম্বর অধিদফতরের তথ্য, শিক্ষা ও উদ্বুদ্ধকরণ (আইইএম) পরিচালক  ড. আশরাফুন্নেছাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সকাল সাড়ে ১০টা থেকে ২:৩০টা পর্যন্ত দুদকের উপপরিচালক মো. সালাহউদ্দিন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। জিজ্ঞাসাবাদে দুদক কর্মকর্তাদের অধিকাংশ প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন অথবা চুপ থাকেন ড. আশরাফুন্নেছা। তবে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সাংবাদিকদের আশরাফুন্নেছা বলেন, ‘অধিদফতরের একটি প্রকল্প অনিয়ম নিয়ে একটি অভিযোগ উঠেছে। সেই বিষয়ে দুদকের কিছু জিজ্ঞাসা ছিল, তাদের কাছে আমি আমার বক্তব্য দিয়েছি।
এর আগে ২৬ আগস্ট, ২০২০ দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে ড. আশরাফুন্নেছার চাচাত ভাই সুকর্ন ইন্টারন্যাশনালের মালিক ফাইজুল হককে জিজ্ঞাসাবাদ করেন দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা।
জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে দুদকের তখনকার সিনিয়র সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখত বলেন, ‘আমাদের হটলাইন ১০৬-এ একটি অভিযোগ আসে, সেই অভিযোগের ভিত্তিতে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরে আশরাফুন্নেছার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের অনুসন্ধানে তিন সদস্যের একটি টিম অভিযান পরিচালনা করে। সেখানে কিছু অনিয়মের সত্যতা মেলে। প্রাথমিক অনুসন্ধানে তথ্য মিলেছে বলেই এ জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
প্রাথমিক অনুসন্ধানে ড. আশরাফুন্নেছার লুটপাটের যেসব প্রমাণ পেয়েছে দুদক
ড. আশরাফুন্নেছার দুর্নীতি-লুটপাটের যেসব প্রমাণপত্র দুদক প্রাথমিক অনুসন্ধানে পেয়েছে তাতে বলা হয়েছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের আইইএম ইউনিট সারাদেশে ৪৮৬ টি ওয়ার্কশপ ও সেমিনার আয়োজন করে। ওই কর্মশালায় অধিদফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্মানীভাতা ও যাতায়াত বাবদ ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে সই জাল করে অর্থ উত্তোলন করা হয়েছে। এভাবে প্রায় ৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ হয়। অধিদফতরের ‘আইইএম ইউনিট’র টঘঋচঅ খাতে ২০১৯ সালে বরাদ্দ ছিল ১ কোটি ২৯ লাখ টাকা। ওই টাকা কোনো কাজ না করেই অগ্রণী ব্যাংক, ওয়াসা ভবন শাখা হতে তোলা হয়।
দুদকের অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়েছে, ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে ৩৯টি কোটেশনের বিল দেওয়া হয়েছে। যার পরিমাণ ছিল ১০ কোটি টাকা। কিন্তু এসব অর্থ ব্যবহার অর্থাৎ কোটেশন, কার্য সম্পাদন এবং বিল পরিশোধের কাগজপত্রে কোনো সঠিকতা নেই। এর মধ্যে ওই বছরে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের পরিচালক ড. আশরাফুন্নেছার আপন ভাগ্নের মালিকানাধীন ‘রূহী এন্টারপ্রাইজ’ কোনো কাজ না করেই ৮৫ লাখ টাকার বিল তুলে নিয়েছে।
অন্যদিকে কাজ না করেই তার আপন চাচাতো ভাইয়ের মালিকানাধীন সুকর্ন এন্টারপ্রাইজকে ১ কোটি টাকার কার্যাদেশ দিয়ে বিল উত্তোলন করা হয়। রূহী এন্টারপ্রাইজ ও সুকর্ন এন্টারপ্রাইজের নামে বরাদ্দ ১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা উত্তরা ব্যাংকের কাওরান বাজার শাখার মাধ্যমে তোলা হয়েছে।
সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজের অনুসন্ধানে ড. আশরাফুন্নেছার বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
দুদকের অভিযোগের সূত্র ধরে ড. আশরাফুন্নেছার দুর্নীতির বিষয়ে খোঁজ নিতে গেলে সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজের হাতে আসে তার দুর্নীতির ভুরি ভুরি প্রমাণ ও অর্থ আত্মসাতের অভিনব সব কৌশলের তথ্য। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজকে জানায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় ৪৮৬টি কর্মশালার নামে কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর জাল, ভুয়া বিল এবং ভাউচারের মাধ্যমে সব টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। কর্মশালার ব্যয় বাবদ তিনি (আশরাফুন্নেসা) যেসব বিল-ভাউচার করেছেন তার বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের কোন অস্তিত্ব নেই। কর্মশালায় ব্যবহারের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো ধরনের টেন্ডার বা কোটেশন ছাড়াই ব্যাগ, কলম, প্যাড ক্রয় করেছেন। তিনটি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান আইইএম পরিচালকের মৌখিক নির্দেশের ভিত্তিতে এসব পণ্য সরবরাহ করে। যেখানে ব্যাগের জন্য ৩৭০ টাকা এবং প্যাড ও কলমের দাম যথাক্রমে ২০ ও ১০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। সেখানে বিল ভাউচারে ব্যাগের দাম দেখানো হয়েছে ১ হাজার ৫০ টাকা, প্যাড ৭০ টাকা, কলম ৮০ টাকা। এছাড়া কর্মশালার রিসোর্স পার্সনদের সম্মানী ভাতা আয়করসহ ১ হাজার ৬৮০ টাকা, অংশগ্রহণকারীদের ভাতা বাবদ ৭শ’ টাকা দেখিয়ে স্বাক্ষর জাল করে উত্তোলন করা হয়েছে।
অন্য একটি সূত্রের তথ্য এবং অধিদপ্তরের কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মৌলভীবাজারে অনুষ্ঠিত কর্মশালার জন্য ‘মেসার্স আচল পেপার’ ‘স্টেশনারী এন্ড লাইব্রেরি’ থেকে ব্যাগ, প্যাড, কলম কেনার তথ্য রয়েছে। যার ঠিকানা স্টেশন রোড, মৌলভীবাজার। ক্যাশ মেমোতে ক্রেতার নাম-ঠিকানা লেখা হয়েছে ‘পরিচালক আইইএম এবং প.প. অধি, ঢাকা’। এছাড়া ‘সাম্পান রেস্টুরেন্ট এন্ড ক্যাটেরিং’ নামে একটি ক্যাশ মেমোতে ক্রেতার একই ঠিকানা ব্যবহার করে আপ্যায়ন উদ্বোধনী ও আপ্যায়ন সমাপনী নামে বিল করা হয়েছে। কিন্তু কোন পণ্যের নাম সেখানে নেই। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মৌলভীবাজার ইউনিট ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটির প্রশ্নের জবাবে লেখেন, উল্লিখিত ঠিকানায় এই দোকানগুলোর অস্তিত্ব তারা খুঁজে পাননি। সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, মৌলভীবাজারে স্টেশন রোড নামে কোন সড়ক নেই। এমনকি ‘মেসার্স আচল পেপার, স্টেশনারী এন্ড লাইব্রেরি’ ‘সাম্পান রেস্টুরেন্ট এন্ড ক্যাটারিং’ নামেও কোন প্রতিষ্ঠান নেই।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, একই ঘটনা ঘটেছে দেশের প্রায় বেশিরভাগ উপজেলায়। মাত্র তিন দিনে ময়মনসিংহ বিভাগের চারটি জেলার ৩৩টি উপজেলায় কর্মশালা সম্পন্ন করা হয়েছে বলে কাগজপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, যা বাস্তবে অসম্ভব। উপজেলা পর্যায়ে কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীদের সম্মানী প্রদানের তালিকার নাম ও স্বাক্ষর ঢাকা অফিসে বসেই ইচ্ছেমত বসিয়ে এসব টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা শীর্ষকাগজকে জানান, কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীদের ব্যাগ কেনেন পরিচালক আশরাফুন্নেছা নিজেই। তবে কোন ধরনের টেন্ডার বা কোটেশন ছাড়াই তিনজন সরবরাহকারীকে তিনি ব্যাগ প্রদানের জন্য মৌখিক নির্দেশ দেন। তার প্রেক্ষিতে ইউমেক্স ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, জারিন এন্টারপ্রাইজ এবং এমআর এন্টারপ্রাইজ যথাক্রমে ৮ হাজার, ৩ হাজার ৪শ’ এবং ২ হাজার ব্যাগ সরবরাহ করে। সূত্র আরো জানায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে কোন কাজ না করেই ৪৮টি কোটেশনের মাধ্যমে ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা উত্তোলন করেছেন আশরাফুন্নেছা। যার কোন নথিপত্র নেই। ভুয়া কার্যাদেশ তৈরি করে বিলের সঙ্গে সংযুক্ত করে এসব বিল এজি অফিস থেকে পাশ করানো হয়েছে। যদিও সরকারি নিয়মানুযায়ী একজন পরিচালকের বছরে ৬টির বেশি কোটেশন করার কোন নিয়ম নেই।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ড. আশরাফুন্নেছা পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের পরিচালক (আইইএম) হিসেবে দায়িত্বগ্রহণের পর ১৮-১৯ ও ১৯-২০ অর্থ বছরে পরিচালকের (আইইএম) গাড়ি মেরামতের নামে কোটি টাকা উত্তোলন করে আত্মসাত করেন। আইইএমের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের দুই বছরে কোটেশনের মাধ্যমে পিপিআর ২০০৮ এর কোন আইনের তোয়াক্কা না করেই নিজেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে এজি অফিস থেকে বিল পাশ করিয়ে আত্মসাত করেছেন প্রায় ৩৪ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা। এছাড়া ক্ষমতার অপব্যবহার করে ড. আশরাফুন্নেছা সরকারি তিনটি গাড়ী ব্যবহার করেছেন পারিবারিক কাজে।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরে ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণীর নিয়োগেও ব্যাপক দুর্নীতি করেছেন ডা. আশরাফুন্নেছা। আইইসি অপারেশনাল প্ল্যানের আওতায় জনবল নিয়োগে তিনি কোন নিয়ম-নীতি বা কোটা সংরক্ষণ না করেই অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ প্রদান করেছেন। তিনি আইইসি প্ল্যানের বাংলাদেশ বেতারের জনবল মোটা অংকের টাকা নিয়ে নিজেই নিয়োগ প্রদান করেছেন। যদিও অপারেশনাল প্ল্যানে উল্লেখ রয়েছে উক্ত জনবল নিয়োগ প্রদান করতে বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালকের অনুমোদন সাপেক্ষে জনসংখ্যা সেলের প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ প্রদান করবেন।
প্রধানমন্ত্রীর ভয়েস ম্যাসেজের নামেও অর্থ লুট করলেন আশরাফুন্নেছা!
২০১৮ সালে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের কাছে একটি সচেতনতামূলক ভয়েস ম্যাসেজ প্রচারের সিদ্ধান্ত নেয় পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর। যার বাজেট ছিল ৯৯ লাখ টাকা। অধিদফতরের তথ্য, শিক্ষা ও উদ্বুদ্ধকরণ (আইইএম) ইউনিটকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি ভয়েস মেসেজ প্রস্তুত করে একটি বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে তা এক কোটি মানুষের কাছে পৌঁছানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়। আইইএম ইউনিট এই কাজের জন্য কবির এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচিত করে। ওই বছরের ৬ এপ্রিল তাদের কার্যাদেশ দেওয়া হয়। কার্যাদেশ দেওয়ার পর দুই বছর পেরিয়ে গেলেও কোনো মোবাইল ব্যবহারকারীর কাছে এমন মেসেজ পাঠানো হয়নি। এমনকি কোনো মেসেজ তৈরিই করা হয়নি। তবে ইতোমধ্যে কবির এন্টারপ্রাইজকে পুরো অর্থই পরিশোধ করে দেওয়া হয়েছে।
অভিযুক্ত হওয়ার পরও স্বাস্থ্যমন্ত্রী-সচিবের সাথে বিদেশ ভ্রমণ
দুর্নীতি দমন কমিশনের টিম পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরে অভিযান চালিয়ে ব্যাপক দুর্নীতি-লুটপাটের তথ্যপ্রমাণ পায় ২০১৯ সালের ২৪ অক্টোবর। দেশের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যমগুলোয় এ নিয়ে ফলাও করে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। স্বাস্থ্যখাতসহ সরকারি মহলে ব্যাপক তোলপাড় বয়ে যায়। কিন্তু আশরাফুন্নেছাকে তাৎক্ষণিকভাবে অধিদফতর থেকে সরিয়ে দেয়াসহ তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার প্রস্তাব করা হলেও সেটি বাস্তবায়ন করা যায়নি মন্ত্রীর কারণে। এমনকি অভিযুক্ত হওয়ার পরেও সমালোচনা ও নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে এ ঘটনার পর পরই আশরাফুন্নেছাকে বিদেশ ভ্রমণে সফর সঙ্গী করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও সচিব। আশরাফুন্নেছাকে সফর সঙ্গী করে ‘নাইরোবি সামিটে’ যোগ দেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক এবং মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের তৎকালীন সচিব শেখ ইউসুফ হারুন। ১২ থেকে ১৪ নভেম্বর ২০১৯ কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবিতে ‘দ্য নাইরোবি সামিট অন আইসিপিডি ২৫: অ্যাসেলারেটিং দ্য প্রমিজ’ অনুষ্ঠানে যোগ দেন মন্ত্রী-সচিব। ‘ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন পপুলেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইসিপিডি)’ এর ২৫তম সম্মেলনে বাংলাদেশ থেকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের নেতৃত্বে ৮ সদস্যের প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য হিসেবে সেখানে যান পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের পরিচালক আশরাফুন্নেছা।
আশরাফুন্নেছার সম্পদের পাহাড়
ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার শ্যামগঞ্জের এক সাধারণ কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন আশরাফুন্নেছা। তিনি মূলত শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা, প্রশাসনে এসে পরে যুগ্মসচিব পর্যন্ত পদোন্নতি পান। পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের (আইইএম) পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে। আইইএমের পরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণের পর অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তার বিত্ত-বৈভবের খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বেইলী রোডের মহিলা ক্লাবের পাশে এপার্টমেন্ট প্রজেক্টে ৫ম ও ৮ম তলায় তার ৩৩০০ বর্গফুট আয়তনের দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে। প্রতিটি ফ্ল্যাটের মূল্য সাড়ে তিন কোটি টাকা। তার ছোট ভাই রানার নামে নিকেতনের ডি ব্লকে ৭নং রোডের ৮/বি প্রজেক্টে কিনেছেন দুইটি বিলাস বহুল ফ্লাট। যার দাম প্রায় ৭ কোটি টাকা। তার আরেক ছোট ভাই মামুনের নামে নিকেতনের ডি ব্লকের ৬ নং রোডের ২৩/এ এপার্টমেন্ট প্রজেক্টে কিনেছেন একটি ফ্ল্যাট যার দাম দেড় কোটি টাকা। ছোট বোনের নামেও দেড় কোটি টাকায় নিকেতনে কিনেছেন একটি ফ্ল্যাট। ছোট ভাই রানার নামে আফতাব নগরে সি ব্লকে কিনেছেন ৮ কাঠা জমি। যার দাম প্রায় ১০ কোটি টাকা। এছাড়াও আশরাফুন্নেছার নামে বেনামে রয়েছে কোটি কোটি টাকা। যার অধিকাংশই তিনি কামিয়েছেন পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তদন্তেও দুর্নীতি প্রমাণিত
শুধু দুদক নয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব শাব্বির হোসেনের নেতৃত্বে অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটির তদন্তেও অভিযোগ প্রমাণিত হয়। দুদকের অভিযান ও প্রাথমিক তদন্তে দুর্নীতি প্রমাণের পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আসলে মন্ত্রণালয় এক পর্যায়ে বাধ্য হয় অভ্যন্তরীণ তদেন্তের উদ্যোগ নিতে। অতিরিক্ত সচিব শাব্বির হোসেনের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। শাব্বির হোসেনের কমিটির তদন্তেও ড. আশরাফুন্নেছ্রা দুর্নীতি প্রমাণিত হয়।
অতিরিক্ত সচিব শাব্বির হোসেন এ ব্যাপারে এক প্রতিক্রিয়ায় গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, ‘তদন্ত শেষে আমরা প্রতিবেদন জমা দিয়েছি এবং আমরা অসঙ্গতি খুঁজে পেয়েছি। তদন্তে জানতে পেরেছি যে অভিযোগ সত্য।’ গত বছর সেেেপ্টম্বরের শেষে এই প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয় বলে জানা যায়।
তারপরও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হলো না!
অবাক ব্যাপার হলো, দুদক এমনকি মন্ত্রণালয়ের তদন্তে দুর্নীতি-লুটপাট প্রমাণিত হবার পরও ড. আশরাফুন্নেছার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যায়নি। যদিও ২৪ অক্টোবর, ২০১৯ইং দুদকের বিশেষ এনফোর্সমেন্ট টিমের অভিযানে প্রাথমিক তথ্য-প্রমাণ পাওয়া এবং ব্যাপক হইচই’র পরপরই তাকে বদলিসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ হয়েছিল সেটি পরে আর বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে ড. আশরাফুন্নেছার অপকর্মের মাত্রা কমেনি।
স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব পদে ওই সময় যিনি ছিলেন এবং আশরাফুন্নেছার বিদেশ সফরসঙ্গী হয়েছিলেন সেই শেখ ইউসুফ হারুন পরবর্তীতে জনপ্রশাসন সচিব পদে আসেন। ফলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তাকে বদলির আর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। এদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও বদলি, বিভাগীয় মামলা বা অন্য কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারেনি মন্ত্রীর কারণে। অন্যদিকে দুদকের তদন্তও চলেছে অত্যন্ত ঢিমে তালে। প্রাথমিক তদন্তে ব্যাপক দুর্নীতি-লুটপাটের প্রমাণ পাওয়ার পর দীর্ঘ দেড় বছর অতিক্রান্ত হতে চললেও এখন পর্যন্ত দুদকের সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী কর্মকর্তারা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেননি।
(সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজে ১ মার্চ ২০২১ প্রকাশিত)