খ্যাতিমান মুক্তিযোদ্ধারাও যাচাইয়ের মুখোমুখি!

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),ঢাকা প্রতিনিধি,৩০ ডিসেম্বর : দেশের খ্যাতিমান কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রমাণের জন্য উপজেলা পর্যায়ে গঠিত যাচাই-বাছাই কমিটির মুখোমুখি হতে বলা হয়েছে। এই মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে রয়েছেন সাংবাদিক ও সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের মহাসচিব হারুন হাবীব, বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত সদরুজ্জামান হেলাল, মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় সংসদের প্রতিষ্ঠাতা সহসভাপতি রেজাউল করিম, একই সংসদের প্রথম মহাসচিব নঈম জাহাঙ্গীর ও চট্টগ্রাম শহরের যুদ্ধকালীন কমান্ডার ইঞ্জিনিয়ার আফসার।

খ্যাতিমান মুক্তিযোদ্ধাদের নামসহ যাচাই-বাছাই তালিকা প্রকাশ করায় মুক্তিযোদ্ধারা বিব্রতকর অবস্থায় পড়ছেন। এ নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। এভাবে নাম প্রকাশের মাধ্যমে খ্যাতিমান মুক্তিযোদ্ধাদের বিতর্কিত করা হচ্ছে বলেও তাঁরা মনে করছেন।

জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) অনুমোদন ছাড়া ২০০২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত যাঁরা গেজেটভুক্ত (বেসামরিক গেজেট) হয়েছেন, তাঁরা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা কি না যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে জামুকা। সারা দেশে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এ যাচাই-বাছাইয়ের তারিখ প্রথমে ১৯ ডিসেম্বর নির্ধারণ করা হলেও পরে তা পরিবর্তন করে আগামী ৯ জানুয়ারি ঠিক করা হয়েছে। এ জন্য গত ৮ ডিসেম্বর ৩৯ হাজার ৯৬১ জন মুক্তিযোদ্ধার উপজেলাভিত্তিক একটি তালিকাও প্রকাশ করা হয়। এ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হওয়ায় বলা হয়, কোনো মুক্তিযোদ্ধার নাম ভারতীয় তালিকা বা লাল মুক্তিবার্তা বা মন্ত্রণালয়ের স্বীকৃত ৩৩ ধরনের প্রমাণকে অন্তর্ভুক্ত থাকলে তিনি যাচাই-বাছাইয়ের আওতার বাইরে থাকবেন।

এ ব্যাপারে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষ কালের ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি)কে জানিয়েছিলেন, তালিকাটি সংশোধন করে শুধু যাঁদের যাচাই-বাছাইয়ের মুখোমুখি হতে হবে তাঁদের নামের তালিকা প্রকাশ করা হবে।

এরপর ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত তালিকা হালনাগাদ করার তথ্য জানানো হয়েছে মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে।

তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য উপজেলা পর্যায়ে চার সদস্যের কমিটির সভাপতি হলেন ওই উপজেলার একজন যুদ্ধকালীন কমান্ডার বা ভারতীয় তালিকা বা লাল মুক্তিবার্তায় অন্তর্ভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা। আর সদস্যসচিব হলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। জামুকার সিদ্ধান্ত অনুসারে, গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের কমপক্ষে তিনজন ভারতীয় তালিকাভুক্ত বা লাল মুক্তিবার্তা তালিকাভুক্ত সহযোদ্ধা বা সহপ্রশিক্ষণ গ্রহীতা সাক্ষী ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র উপস্থাপন করতে হবে। কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে থাকলে তিনি কোন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, তা-ও তিনজন ভারতীয় বা লাল মুক্তিবার্তা তালিকাভুক্ত সহমুক্তিযোদ্ধার মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে। ভারতীয় বা লাল মুক্তিবার্তা তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতিতে এ যাচাই-বাছাই কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে।

জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধে কর্নেল তাহেরের (বীর উত্তম) নেতৃত্বাধীন ১১ নম্বর সেক্টরের বহুল পরিচিত মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীন বাংলা বেতার ও মুক্তিযুদ্ধকালীন জয়বাংলা পত্রিকার যুদ্ধ সংবাদদাতা হারুন হাবীবের নাম জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার তালিকায় প্রকাশ করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রথম মহাসচিব নঈম জাহাঙ্গীরের নাম মেলানদহ ও সদরুজ্জামান হেলালের (বীরপ্রতীক) নাম জামালপুর সদর উপজেলার তালিকায় প্রকাশ করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় সংসদের প্রতিষ্ঠাতা সহসভাপতি রেজাউল করিমের নাম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার তালিকায় প্রকাশ করা হয়েছে। এই মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ভারতীয় তালিকা ও লাল মুক্তিবার্তায় রয়েছে বলে জানা গেছে।

খ্যাতিমান মুক্তিযোদ্ধাদের নাম যাচাই-বাছাইয়ের তালিকা প্রকাশ করার বিষয়ে কর্নেল তাহেরের অনুজ ও বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত ওয়ারেসাত হোসেন বেলালের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি)কে বলেন, এটি একটি খুবই ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে। যাঁরা সম্মুখ সমরে বীরত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, যাঁরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিকাশের লক্ষ্যে দীর্ঘ সময় ধরে লড়াই করেছেন, এখন যদি বলা হয় তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা কি না তা যাচাই-বাছাই করতে হবে—এর চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য আমাদের আর কী হতে পারে? এই তালিকায় তাঁদের নাম প্রকাশ করার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার মাধ্যমে যে ক্ষতি করা হলো তা কিভাবে পোষাবে আমি জানি না।’

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি)’র পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে হারুন হাবীব জানান, মুক্তিযুদ্ধের সহযোদ্ধাদের কাছ থেকে তিনি বিষয়টি জেনেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি কী আর বলব, মন্ত্রণালয় বা জামুকা এ রকম একটি কাজ কেন করতে গেল তা তো আমার পক্ষে জানা সম্ভব নয়। তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক, এ বলা ছাড়া আর কী বলতে পারি আমি?’

মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় সংসদের প্রতিষ্ঠাতা সহসভাপতি মো. রেজাউল করিম ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি)কে বলেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক হিসেবে আমাকে সবাই চেনেন। আমরাই প্রথম মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় সংসদ প্রতিষ্ঠা করি। এখন ৭৭ বছর বয়সে আমি মুক্তিযোদ্ধা কি না তা যাচাইয়ের মখোমুখি হওয়া আমার জন্য চরম অপমানের।’

চট্টগ্রামকেন্দ্রিক মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান সম্প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে ফেসবুকে লিখেছেন, চট্টগ্রাম শহরের যুদ্ধকালীন কমান্ডার ইঞ্জিনিয়ার আফসার এবং বন্দর নগরীর সুপরিচিত মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহবুব ও শাহাবুদ্দিনকে ভারতীয় তালিকা ও লাল মুক্তিবার্তা তালিকায় নাম থাকা সত্ত্বেও নতুন করে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য ডাকা হয়েছে। তিনি মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়কে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেন, যাঁদের নতুনভাবে ডাকা হয়েছে তাঁরা চট্টগ্রাম অঞ্চলের সুপরিচিতি মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এবং কিংবদন্তি নায়ক।