শেখ রেহানা: মিথ্যার দেয়ালে প্রথম আঘাতকারী এক সংগ্রামী জীবনের উপাখ্যান

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),ঢাকা প্রতিনিধি,১৩ সেপ্টেম্বর : ১৯৭৫ সালের এক অভিশপ্ত ভোরে তারা দুজনই হারিয়েছিলেন পরিবারের সবাইকে। সেই ভয়ংকর সময়ে বাংলাদেশ থেকে ৭ হাজার ৭শ ৩০ কিলোমিটার দূরে বেলজিয়ামে থাকার কারণে প্রাণে বেঁচেছিলেন দুই বোন শেখ রেহানা এবং শেখ হাসিনা। বলা বাহুল্য সেই থেকে কিছুই আর আগের মত থাকেনি এই দুই নারীর জীবনে। সবকিছু বদলে গিয়েছে। তারুণ্যের যে সময়টিতে তার উচ্ছ্বলতার স্রোতে ভেসে যাওয়ার কথা সে সময়েই তাকে থমকে যেতে হয়েছে। যেখানে জীবনের নিশ্চয়তাই ছিল অনিশ্চিত সেখানে জীবনের আনন্দ উপভোগ করবার মত অবস্থা তার ছিল না কখনোই। জীবন নিয়ে ভয় আতঙ্ক কখনোবা তৎকালীন নোংরা রাজনীতির কড়াল গ্রাস তাকে তাড়া করে ফিরেছে জীবনভর। কিন্তু সংগ্রামের অমোঘ নেশা তাকে বাঁচিয়েছে বারংবার। তিনি জেগে উঠেছেন, ঘুরে দাঁড়িয়েছেন, জবাব দিয়েছেন, জয়ী হয়েছেন জীবনের অসম যুদ্ধে।

১৫ আগস্টের নৃশংসতা শেখ রেহানাকে যেমন দুর্বল করেছিল তেমনিভাবে আরেকদিক থেকে একরোখা এবং গভীরভাবে নিবেদিতপ্রাণও করে তুলেছিল। জীবিত দুই বোনকেই যে তাদের পরিবারের হত্যার বিচার করতে হবে তা তারা কড়ায় গণ্ডায় বুঝতে পারেন। ২০১৩ সালে লন্ডনে একটি শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাতকারে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ব্যাপারে খোলামেলাভাবেই অনেক কথা বলেন শেখ রেহানা। কীভাবে একসময় প্রতিদিন যারা শেখ রেহানার কাছে আসত তারাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন সেসব দুঃসহ স্মৃতির কথা উঠে আসে সেই সাক্ষাতকারে। সেখানে তিনি সাফ জানিয়েছেন, তাজউদ্দীন ‘কাকা’র সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কোন দূরত্ব ছিল না। এছাড়াও খন্দকার মোশতাক যে চরম পর্যায়ের বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে সেকথাও তিনি বলেছিলেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন- ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে তো ব্রুটাস, মীর জাফরদের আবির্ভাব ঘটে, মোশতাকের আগমনও আমরা সেভাবেই দেখি। রেহানা বলেন, আমার দাদির মৃত্যুর পর মোশতাকের সেই অস্বাভাবিক কান্না এখনো আমার চোখে ভাসে। আব্বাসহ আমরা সবাই ছিলাম শোকে কাতর। কিন্তু একমাত্র মোশতাকই তখন মাঠিতে গড়াগড়ি করে কান্নাকাটি করছেন, যা অনেককেই অবাক করেছে। তখন তো আর বুঝতে পারিনি- আব্বার বিশ্বাসে ঢুকতে এ ছিল তার অভিনয়।

বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার পর যে মিথ্যা আর কলুষের দেয়াল অন্ধকার করে রেখেছিল গোটা জাতিকে- সেই মিথ্যার দেয়ালে তিনিই প্রথম আঘাত করেন। ১৯৭৯ সালের উত্তাল সময়ে যখন জননেত্রী শেখ হাসিনা দিল্লিতে অবস্থান করছিলেন, তখন স্টকহোমে সর্ব ইউরোপীয় বাকশালের সম্মেলনে শেখ রেহানা প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন শেখ হাসিনার পক্ষে। সেখানেই তিনি জীবনে প্রথমবারের মত কোন রাজনৈতিক সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। সেবারই প্রথম আন্তর্জাতিক কোন সম্মেলনে ৭৫’র কলঙ্কজনক হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করেন। সেই সম্মেলনে রাখা বক্তব্যে তিনি ইউরোপের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, জাতিসংঘ মহাসচিব, অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনের প্রধানদের কাছে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যার বিচার চান।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে তার সেই আবেগঘন বক্তব্য আজো বিশ্ববাসী স্বমহিমায় লিপিবদ্ধ করে রেখেছে, পৃথিবীর ইতিহাসে তা রয়ে গেছে চিরন্তন উদাহরণ হিসেবে।

জীবনের সব মুহূর্তেই শেখ রেহানা ১৫ আগস্টের ভয়াল হত্যাকাণ্ডের বিচার পেতে সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ৭৯ সালের জুনে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিশিষ্ট কৌঁসুলি ব্রিটিশ আইনজীবী স্যার টমাস উইলিয়ামসের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি। দিল্লিতে অবস্থানরত বড়বোন শেখ হাসিনার সঙ্গে শলা পরামর্শ করে তিনি সর্ব ইউরোপীয় বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠন করেন। পরবর্তীতে স্যার টমাস উইলিয়ামসকে সর্বসম্মতিক্রমে সভাপতি পদটি দেওয়া হয়।

পরবর্তীতে ১৯৮০ সালে যখন শেখ হাসিনা তার দুই সন্তানকে নিয়ে দিল্লি থেকে লন্ডনে যান তখন উইলিয়ামস ব্রিটিশ পার্লামেন্টে শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানান। শেখ হাসিনা আমন্ত্রণ রক্ষা করে বঙ্গবন্ধু হত্যার তদন্ত কমিশন গঠন করার দায়িত্ব নিতে স্যার উইলিয়ামসকে অনুরোধ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে ১৯ সেপ্টেম্বর লন্ডনের হাউস অব কমন্সের নিকটবর্তী কুন্দুন রেস্টুরেন্টে এক সংবাদ সম্মেলনে স্যার উইলিয়ামসন বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের তদন্ত কমিশন গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। এই কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন টমাস উইলিয়ামস। এছাড়াও এই কমিশনে ছিলেন সদস্যরা হলেন নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী বিখ্যাত আইরিশ আইনজীবী সন ম্যাকব্রাইড, লেবার পার্টির আইনবিষয়ক মুখপাত্র জেফরি টমাস কিউসি এমপি এবং সলিসিটার অব্রে রোজ। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারে আন্তর্জাতিক এই তদন্ত কমিটির ভূমিকা অপরিসীম ছিল।

ছয় বছরের নির্বাসিত জীবনের অবসান ঘটিয়ে স্বদেশভূমিতে ১৯৮১’র সালের ১৭ মে ফিরে আসেন শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর জাতীয় সংসদে কুখ্যাত ‘ইনডেমনিটি’ অধ্যাদেশ বাতিল করা হয়ে গেলে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার শুরু করা যায়। তবে ১৯৭৯ এই এই কাঙ্খিত বিচারের বীজ বপন করা হয়েছিল।

১৯৯৬ সালে দলকে ক্ষমতায় ফেরান শেখ হাসিনা। ২০০১ সালে বিএনপি-জামাত জোট ক্ষমতায় আসার তিন বছরের মাথায় পুনরায় কালো থাবা পড়ে এই ঐতিহ্যবাহী দলটির কাণ্ডারী শেখ হাসিনার ওপর। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে জঘন্যতম হামলাটি হয় ২১ আগস্টে।

২০০১ সালে দলীয় কার্যক্রমে নিয়মিত ছিলেন শেখ রেহানা। কিন্তু ভাগ্যগুণে সেই নির্দিষ্ট দিনটিতে বোনকে বাসায় রেখেই বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে সমাবেশে যোগ দিতে যান তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা।

সেই দিনটির কথা স্মরণ করে শেখ রেহানা  ‘হাসিনা: আ ডটার’স টেল’ নামের প্রামাণ্যচিত্রে বলেন, ‘আমি খুব অনুরোধ করলাম আপাকে, আপা আমি যাই তোমার সাথে আজকে। তো উনি বললেন, ‘না, তুমি বাসায় থাকো, তোমার যেতে হবে না’
‘না আমি যাই তোমার সাথে, আজকে যাব আমি। (আপা বললেন) ‘না তুমি যাবা না’। আমি তখন অভিমান করে, খুব রাগ… ছোটবেলার মতই ধামধুম করে ঘরের ভিতর চলে গেলাম।’

২১ আগস্ট যখন শেখ হাসিনা সুধা সদনে তার গাড়িতে ফিরেছিলেন তখন তার সারাশরীরে/মুখে রক্ত লেগেছিল। সেই দুর্বিষহ স্মৃতিকথায় শেখ রেহানা বলেন,  ‘এর মধ্যে আপার গাড়িটা এলো, এসে দাঁড়ালো। আমি সেখানে দাঁড়ানো। দেখলাম, আপার সমস্ত শরীরে, শাড়িতে, মুখেচোখে রক্ত ভরা। আমি আস্তে আমার আঁচলটা দিয়ে আপার এগুলো মুছে আপাকে ধরে ভেতরে আনলাম।’

২১ আগস্টের মত দুর্বিষহ সময়েও তিনি জননেত্রী শেখ হাসিনার পাশে থেকে নিজের সবটা উজাড় করে দল ও দেশের স্বার্থে কাজ করে গেছেন। এক মুহূর্তও তিনি জননেত্রীকে একা বোধ করতে দেননি।

শুধু তাই নয়, পরবর্তীতে বাংলাদেশ এক এগারো অধ্যায়ে পৌঁছালে আওয়ামী লীগের ভেতর যে ফাটল দেখা দিয়েছিল তা তিনি পর্দার আড়ালে থেকে রোধ করেন। শেখহাসিনা গৃহবন্দী থাকাকালীন দলকে একত্রিত রাখতে পারবেন এমন একজন মানুষের খুব দরকার ছিল তখন। তিনি সেই ভূমিকাতেই অবতীর্ণ হন আপন মহিমায়। বাংলাদেশের পরবর্তী সময়ের ইতিহাস দেখলেই বোঝা যায় কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল শেখ রেহানার অবদান। কারণ ১/১১ এর অন্ধকারযুগ কাটার পরই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভাগ্য নিয়ন্ত্রণে একচ্ছত্র ভূমিকা রেখেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। শেখ রেহানা সেই দলটিকেই ভেঙে ছিন্ন হওয়া থেকে বাঁচিয়েছিলেন গভীর মমত্ব ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে।

ব্যক্তিগত জীবনেও মহানুভবতা আর উদারতার অজস্র উদাহরণ রেখেছেন শেখ রেহানা। ২০০১ সালে সরকার কর্তৃক ধানমণ্ডি ছয় নম্বর রোডের ২১ নম্বর বাড়িটি সরকারিভাবে বরাদ্দ দেওয়া হয়। তিনি তা নগদ মূল্যে ক্রয় করলেও পরবর্তীতে ২০০৫ সালে চার দলীয় জোট ক্ষমতায় এসে সেখানে ধানমণ্ডি থানা স্থাপন করেন।

পরে বাড়ি ফিরে পাওয়ার লক্ষ্যে ২০০৬ সালের ২৪ জানুয়ারি আইনি লড়াইয়ে নামেন তিনি। তিনি বাড়িটি আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ফিরেও পান। তবে সেই বাড়িতে তিনি থাকেননি। তিনি জানান, যেহেতু বাড়িটি থানা হিসাবে জনকল্যাণে ব্যবহৃত হচ্ছে তাই সেটি থানা হিসেবেই থাকবে।

শেখ রেহানার বিয়ে সম্পন্ন হয় লন্ডনের কিলবার্নে, ১৯৭৭ এ। তবে বঙ্গবন্ধু  বেঁচে থাকতেই ৭৪’সালে বিয়ের এই প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। কিন্তু ৭৫ এর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর যে স্বপ্নে আকাশপ্রতীম বাধা আসে। যেখানে পুরো পরিবারই মৃত সেখানে বিয়ের বাদ্য বাজবে কী করে তা নিয়ে সন্দিহান ছিলেন সকলেই। এই বিষয়ে শেখ রেহানা তার একটি সাক্ষাতকারে জানান, একই প্রস্তাব যখন আবার (১৯৭৭) এলো তখন বোন শেখ হাসিনা তার মতামতের ওপরই ছেড়ে দিয়েছিলেন বিষয়টি। কিন্তু নিজের মাথার উপরে একটি ছায়ার আশায় বিয়ের প্রস্তাবটিতে সম্মতি দেন তিনি।

বহমান জীবনের সূত্র মেনেই বিয়ের পিড়িতে বসেন সাউদাম্পটন ইউনিভার্সিটিতে উচ্চ শিক্ষায় অধ্যয়নরত শফিক সিদ্দিকের সঙ্গে। বঙ্গবন্ধুর ফুফাতো ভাই মোমিনুল হক খোকার বাড়িতে এই বিয়ে সম্পন্ন হয়। এখানে আরেকটি গল্প না বললেই নয়, যখন পরিবারের সকলেই শাহাদাত বরণ করেছেন তখন একমাত্র বোনের বিয়েতে টিকিটের টাকার অভাবে যেতে পারেননি শেখ হাসিনা। সেই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন শেখ রেহানার স্বামী শফিক সিদ্দিক।

নিজের বইয়ে শফিক সিদ্দিক লিখেছেন, ‘৮৩ সালে তখন হাসিনা আপা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে ঢাকায় অবস্থান করছেন। ঐ সময়ে আমি আমার পিএইচডি থিসিসের কাজে ঢাকা গিয়েছিলাম। একদিন হাসিনা আপার বাসায় উপস্থিত হয়ে দেখতে পেলাম, উনি হাশেম ভুইয়াঁ নামের একজন কর্মীর অসুস্থ মেয়েকে লন্ডন পাঠাবার ব্যবস্থা করছেন। তখন হাসিনা আপা বেশ দুঃখ করে আমাকে বললেন, ‘শফিক দেখ, আজকে আল্লাহর ইচ্ছায় আমি আমার একজন কর্মীর অসুস্থ মেয়েকে বিদেশ পাঠাতে সাহায্য করতে পারি। কিন্তু সেদিন আমার একমাত্র বোনের বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে দিল্লী থেকে লন্ডন যেতে পারিনি, কেবল টিকেটের টাকার অভাবে।’

শেখ রেহানার স্বামী শফিক আহমেদ সিদ্দিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে চাকরি করলেও জীবনের কোন পর্যায়েই তিনি তার রাজনৈতিক প্রতিপত্তি দেখাননি। তবে স্ত্রীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার উপর তার আস্থা ছিল অগাধ। বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, শেখ রেহানা যদিও রাজনীতিতে আসতে অনিচ্ছুক, কিন্তু প্রয়োজন ও সময় হলে তিনি রাজনীতিতে আসতে পারেন। তিনি বিবিসিকে আরেকটু গুরুত্বপূর্ণ কথাও বলেছিলেন। সেটি হলো- ‘সবচেয়ে সুন্দর হবে জয় যদি সরকারে থাকে, রেহানা যদি পার্টিতে থাকে। জয় সরকার চালাবেন, রেহানা পার্টি চালাবেন, আমার মনে হয় এই কম্বিনেশনটা ভাল হবে।’ তবে তিনি তার বিশ্লেষণ থেকে সংবাদমাধ্যমে অনুমাননির্ভর সংবাদ প্রকাশ না করতেও অনুরোধ করেন।

শেখ রেহানা বঙ্গবন্ধু পরিবারের সবচেয়ে দুঃখী চরিত্র। তার জীবন বারংবার থমকে গেছে। কিন্তু তিনি সবকিছু আগলে রেখেছেন এক অদৃশ্য শক্তি দিয়ে। তার রাজনৈতিক রূপটি যেমন শক্তিশালী-কঠোর এবং বুদ্ধিদীপ্ত তেমনি তার মাতৃরূপটিও কোমল-নরম-প্রাচীন। তার নিজের তিন সন্তানকে তিনি সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। তার ছেলের নাম রেদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি। তার দুই কন্যা হলেন- টিউলিপ সিদ্দিক ও আজমিনা সিদ্দিক। উল্লেখ্য, টিউলিপ সিদ্দিক লন্ডনের ক্যামডেন কাউন্সিলের লেবার পার্টির পক্ষ নিয়ে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন।

শুধু নিজের সন্তানদেরকেই নয়, পরম মমতায় তিনি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সন্তানদেরকেও মানুষ করেন। সে দায়িত্বও তিনি পালন করেছেন পরম বিশ্বস্ততা এবং আস্থার সঙ্গেই। শেখ হাসিনাকে তিনি বলতেন, ‘আপা তুমি বড়, তুমি রাজনীতিটাই করো। আমি তোমার ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা করি।’

পিতার আদর তিনি পেয়েছিলেন অনেক ছোটবেলায়। বঙ্গবন্ধু কীভাবে নিউমার্কেট থেকে কোন এক ঈদের প্রাক্কালে তার ভাইবোনদের জামা কিনে দিয়েছিলেন আর কতটা খুশি তিনি হয়েছিলেন আজো সব মনে রেখেছেন তিনি। তার স্মৃতি থেকে অমোচনীয় তার বাবার আদর। পিতার ভালোবাসা স্মরণ করে তিনি বলেছেন, ‘বাবা যখনই বাসায় আসতেন, যত রাতই হোক, তিনি নিজের হাতে আমাকে খাইয়ে দিতেন। ছোটবেলায় আমি তেমন খেতে চাইতাম না, ঘুমের ভান করে পড়ে থাকতাম। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সবসময় বুঝতে পারতেন যে আমি ঘুমের ভান করছি। ’

বঙ্গবন্ধুও নিজের প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন তার কন্যাদের। যদিও নিজের কোন মেয়ের বিয়েতেই তিনি উপস্থিত থাকতে পারেননি। এছাড়াও শেখ রেহানা এবং শেখ হাসিনা তাকে মাঝে মাঝে বাসায় পেতেন। কারণ বিভিন্ন সময়েই ঈদ-পার্বণেও কারাগারে থাকতে হত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তবে কন্যাদের কেমন ভালোবাসতেন শেখ মুজিব তা শেখ রেহানার কথাতেই তা স্পষ্ট। তিনি বলেন, আমাদের কাছে ঈদ ছিল তখন, যখন আব্বা জেলখানার বাইরে থাকতেন, মুক্ত থাকতেন। আব্বাও জেলের বাইরে, ঈদও এলো এমন হলে তো কথাই নেই, আমাদের হতো ডাবল ঈদ।’ রেহানা আরেকটি স্মৃতিচারণে পিতাকে নিয়ে বলেন, ‘মারধর তো দূরের কথা, কখনো বকাও দিতেন না। শুধু এমনভাবে তাকাতেন যে আমরা বুঝে ফেলতাম যে কোনো ভুল করে ফেলেছি।’

দেশের বিভিন্ন সংকটময় মুহূর্তে নিজের সবটা নিয়ে দেশ ও জাতির পাশে দাঁড়িয়েছেন এই মহিয়সী নারী। কোনদিন কোন পদ নেননি তিনি। কোন লোভ করেননি তিনি। শেখ হাসিনাকে পরামর্শ দেওয়া এবং দেশের জন্য কাজ করে যাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়েই নিজের অগোছালো জীবন বেছে নিয়েছেন তিনি।    বিশেষ কোন সুবিধাই যেন তার নয়। এমনকি ব্রিটেনেও তিনি ব্যবহার করেন পাবলিক ট্রান্সপোর্ট। তিনবার যার বোন প্রধানমন্ত্রী তার সঙ্গে ব্রিটেনে কেউ চাইলেই সহজেই যোগাযোগ করতে পারেন। জননেত্রী শেখ হাসিনা যেমন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন তিনি সেই স্বপ্নের এক প্রধানতম ধারক। নিরহংকার মানুষটি মানুষের মুক্তির স্বপ্ন দেখে গেছেন সারাটি জীবন।

শেখ হাসিনার সহোদরা শেখ রেহানার ৬৫তম জন্মদিন আজ। ১৯৫৫ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। জন্মদিনে এই গুণী মানুষকে শুভকামনা।

তথ্য ও ছবি: বঙ্গবন্ধু অনলাইন আর্কাইভ।