(ভিডিও)রংপুরে গাছের পাতা থেকে হচ্ছে তেল, প্রতি লিটারের দাম ৫০ হাজার!

SHARE

য়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (ভিডিও),রংপুরের পীরগাছা প্রতিনিধি, শনিবার   ০৮ নভেম্বর ২০২৫ ||  কার্তিক ২৪ ১৪৩২ :

গাছের পাতা থেকে উৎপাদন হচ্ছে অত্যন্ত মূল্যবান তেল। সেই তেল আবার শরীরের ত্বকের জন্য উপকারী। এটা কোনো কল্পনা নয় বাস্তব। বাংলাদেশেই এমন এক গাছ জন্মেছে, যা থেকে বের হচ্ছে তেল। প্রথমে শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটিই সত্য।

ঝাউ গাছের মতো দেখতে মূল্যবান এ গাছের পাতা দিয়ে উৎপাদিত তেলের প্রতি লিটারের দাম ৫০ হাজার টাকা। আর তেল উৎপাদনের সময় গাছের পাতা থেকে যে পানি বের হয়, সেই হাইড্রোসল ওয়াটারও বিক্রি হয় প্রতি লিটার অন্তত হাজার টাকায়।

Advertisement

‎রংপুরের পীরগাছা উপজেলার ইটাকুমারী ইউনিয়নের শ্রীকান্ত গ্রামে চাষ হওয়া এই গাছ অস্ট্রেলিয়ার দুর্লভ টি ট্রি। আর এই গ্রামে বসে অত্যাধুনিক উপায়ে টি ট্টির পাতা থেকে তেল উৎপাদন করে দেশে বিক্রির পাশাপাশি বিদেশে রফতানি করছেন প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান আরিফ।
 
তরুণ এই উদ্যোক্তা রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার হরিশচর গ্রামের বাসিন্দা গ্রামের বাসিন্দা। চাকরি করতেন তাইওয়ানের একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে। সেখানে চাকরিরত অবস্থায় টি ট্রি’র পাতা থেকে তেল উৎপাদনের ভাবনা চেপে বসে তার মাথায়। নিজ উপজেলার পার্শ্ববর্তী প্রত্যন্ত গ্রামে এক একর জমি লিজ নেন তিনি।  কিন্তু শুরুতে নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে বিদেশ থেকে টি ট্রি’র চারা আনতে পারেননি।
 
এরপর ২০২০ সালে আন্তর্জাতিক ই-কমার্স সাইটের সহযোগিতায় বিদেশ থেকে টি ট্রি’র অল্প কিছু বীজ সংগ্রহ করেন আরিফ। কিন্তু সেই বীজ থেকে চারা উৎপাদন করতে গিয়ে পড়েন বিপাকে। স্বপ্ন বুননে তবুও থামেননি। এসময় তার পাশে ছিল স্থানীয় কৃষি বিভাগ ও বাংলাদেশ কৃষি ইনস্টিটিউট।
 
 
‎পরীক্ষামূলক ভাবে অস্ট্রেলিয়ান এই গাছের চাষ শুরু করেন আরিফ। প্রতিদিন সকাল বিকেল মাঠে গেছেন। গাছের পরিচর্যা করেছেন। ডালপালা ছেঁটেছে, বীজ শুকিয়েছে। আর প্রতিটি ব্যর্থতা থেকে রপ্ত করেছেন নিত্য নতুন পাঠ। বীজ থেকে ৪০টি চারা থেকে চারা উৎপাদনে সফল হন তিনি। তিন বছরের মধ্যে সেই চারাগুলো থেকে কাটিং পদ্ধতিতে এখন তার এক একরের প্রকল্পে ২ হাজারের বেশি টি ট্রি গাছ রয়েছে।
 
‎সরেজমিনে দেখা গেছে, টি ট্রির পাতা থেকে তেল ও হাইড্রোসল ওয়াটার সংগ্রহের জন্য জমির পাশেই স্থাপন করা হয়েছে অত্যাধুনিক যন্ত্র। গাছ থেকে পাতা সংগ্রহের পর তা পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে যন্ত্রের ভিতরে দিয়ে তা তাপ দেয়ার মাধ্যমে ধীরে ধীরে সংগ্রহ করা হয় টি ট্রি অয়েল ও হাইড্রোসল ওয়াটার। এ কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন শ্রমিকরা।
 
‎তারা জানান, প্রথমে কাটিং পদ্ধতিতে গাছ থেকে পাতা সংগ্রহ করে সেগুলো ড্রামে বিশুদ্ধ পানিতে ধুয়ে স্টিলের চৌবাচ্চায় নিয়ে রাখেন। পরে সেই পাতাগুলো চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা জাল দিয়ে স্টিম ডিস্টিলেশন পদ্ধতিতে বের করা হয় তেল ও হাইড্রোসল। প্রতি ব্যাচে ৫০ কেজি পাতা থেকে তিন ব্যাচে দিনে দেড় লিটার তেল উৎপাদন হয়।

Advertisement

প্রতিটি উপজেলায় সংবাদদাতা আবশ্যক। যোগাযোগ ০১৭১৪৪৯৭৮৮৫

 
‎গ্রামীণ অর্থনীতিতে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলতে পারে টি ট্রি, শুরু থেকে এ বিশ্বাস ছিল প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান আরিফের। কিন্তু শুরুতে গ্রামের সকলের একটাই প্রশ্ন ছিল_ ‘গাছের পাতা থেকে আবার তেল হয় নাকি’? এটা নিয়ে অনেকের ধারণা ছিল তেল উৎপাদন সম্ভব নয়। কেউ বিশ্বাসই করত না একটা ছোট গাছ বড় হলে সেখান থেকে তেল পাওয়া যাবে। এটা আরিফের জন্য অনেকটা চ্যালেঞ্জিং ছিল। কিন্তু বীজ থেকে ৪০টি চারার বাড়ন্ত সময়টুকো আরিফসহ তার সহযোগীদের মনে সাহস যোগায়। 
 
‎গাছ বড় হওয়ার পর পাতা থেকে কীভাবে তেল উৎপাদন করবেন সেটা নিয়েও বিপাকে পড়েন তরুণ এ উদ্যোক্তা। চীন থেকে ছোট একটি মেশিন এনে সেটি বিশ্লেষণ করে স্থানীয়ভাবে ৫০০ লিটার ধারণক্ষমতার মেশিন তৈরি করেন তিনি। বর্তমানে সেই মেশিন দিয়ে সফলভাবে তেল ও হাইড্রোসল উৎপাদন করে তা দেশে ও বিদেশে বিক্রি করছেন। মূল্যবান এসব গাছ থেকে গত তিন বছরে উৎপাদিত হয়েছে প্রায় ৫০ লিটার তেল ও পাঁচ হাজার লিটার হাইড্রোসল ওয়াটার। এ বছর সেই উৎপাদন দ্বিগুণ হবে বলে আশা এই উদ্যোক্তার।
 
আসাদুজ্জামান আরিফ বলেন, বর্তমানে আমার বাগানে দুই হাজারের বেশি টি ট্রি গাছ আছে। এসব গাছ থেকে থেকে পাতা সংগ্রহ করা হয়। তারপর বিশুদ্ধ পানি দিয়ে পরিষ্কার করে মেশিনে দিয়ে সেখান থেকে হাইড্রোসল ওয়াটার ও এসেনসিয়াল অয়েল সংগ্রহ করা হয়। প্রতিবছর গড়ে একেকটি গাছ থেকে পাঁচ কেজি করে পাতা সংগ্রহ হয়। সেই পাতা প্রক্রিয়াজাতকরণে প্রতি কেজি থেকে গড়ে ১০ গ্রাম অয়েল এবং ১৮-২০ লিটার হাইড্রোসল ওয়াটার পাওয়া যায়।
 
‎তিনি আরও বলেন, অত্যন্ত মূল্যবান এই গাছের তেল ত্বক সতেজ রাখতে, খুশকি দূর করতে এবং চুল পড়া রোধে বেশ কার্যকর। এর পানিরও দেশ ও বিদেশে চাহিদা রয়েছে। বিশেষ করে যাদের মুখে ব্রণ, ফাঙ্গাস টাইপের প্রবলেম আছে তাদের জন্য তেলটা খুবই কার্যকর। এছাড়া যাদের চুল পড়া, খুশকিসহ হেয়ার প্রবলেম আছে তাদের জন্যেও এই গাছের তেল এবং পানি বেশ কার্যকরী।
 
আসাদুজ্জামান আরিফ বলেন, পনেরো লাখ টাকা বিনিয়োগে শুরু করা এই টি ট্রি প্রজেক্ট এখন রফতানি পণ্য উৎপাদন করছে। একসময় অত্যন্ত মূল্যবান এই তেল পুরোপুরি বিদেশ থেকে আমদানি করা হলেও এখন অনলাইন প্লাটফর্মের মাধ্যমে পৌঁছে যাচ্ছে বিদেশের বাজারেও। সরকারি সহযোগিতা পেলে এই টি ট্রি চাষই দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে নতুন দরজা খুলে দিবে বলে আশা তরুণ এই উদ্যোক্তার।
 
তিনি বলেন, টি ট্রি পাতার তেল ও হাইড্রোসল ওয়াটার বিশ্বব্যাপী স্কিন কেয়ার, হেয়ার কেয়ার ও ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্যে ব্যবহৃত হয়। দেশের বাইরে এর ব্যাপক চাহিদা আছে। সরকার যদি রফতানি প্রক্রিয়া সহজ করেন, তাহলে এ খাতে বৈদেশিক মুদ্রা আয়সহ অধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারব।
 
 
চলতি বছর তার প্রকল্প থেকে প্রায় ৩০ লাখ টাকা আয়ের স্বপ্ন দেখছেন জানিয়ে আরিফ বলেন, শুরুতে আমার এ প্রজেক্টে আট থেকে দশ কর্মচারী ছিল। এখন লোকবল বেড়েছে। আমার পরিকল্পনা বৃহৎ পরিসরে এই গাছের চাষ করে আরো মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। একই সঙ্গে উৎপাদিত মূল্যবান এই পণ্য সবখানে ছড়িয়ে দিয়ে দেশের ব্রান্ডিং করা

Advertisement

 
পীরগাছার জমি টি ট্রি চাষাবাদের জন্য উপযোগী বলে জানিয়েছেন উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম। এই গাছের চারা উৎপাদন, চাষ ও সম্প্রসারণে কৃষি বিভাগ থেকে সহযোগিতা করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা শুরু থেকে তাকে (উদ্যোক্তা আরিফ) সহযোগিতা করেছি। তার মতো কেউ যদি এমন উদ্যোগ গ্রহণ করেন তাহলে আমরা তাকে সবধরণের সহযোগিতা করব।