(ভিডিও) ড্যান্ডি নেশার ছোবলে পথশিশুরা, জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধে!

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),অপরাধ প্রতিনিধি ,শুক্রবার   ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ||  ভাদ্র ২১ ১৪৩২  :

বয়স আনুমানিক ৮/৯ বছর। নাম সালাই ও বিলাল। তাদের বসবাস সিলেট রেলস্টেশন এলাকায়। এই বয়সে ওদের বই খাতা হাতে নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা। অথচ এরাই এখন সবচেয়ে বিপথগামী। মরণ নেশা ড্যান্ডি নেশায় আসক্ত হয়ে তারা এখন নিশ্চিত অন্ধকারের পথে। তাদের মত আরো শত শত পথশিশু এখন ড্যান্ডি নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছে।

Advertisement

বঞ্চিত শৈশবে সাময়িক সুখে’র প্রত্যাশায় অন্ধকারের চোরাবালিতে হারিয়ে যাচ্ছে এসব শিশুরা। জরাজীর্ণ হয়ে পড়ছে ওদের জীবন। জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডে। মাদক বহনের ক্ষেত্রে হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে এসব শিশু। চুরি ছিনতাইয়েও জড়িয়ে পড়ছে এরা। এ সকল শিশু মাদকসেবীদের পুনর্বাসনে সরকারী কোন উদ্যোগই কাজে আসছে না। শিশু অধিকার আইনে এদের শাস্তির তেমন কোন ব্যবস্থা না থাকায় সহজেই এরা বিপথগামী হচ্ছে।

সমাজবিজ্ঞানীদের মতে এখনই এদেরকে সুপথে ফিরিয়ে না আনলে বাড়বে অপরাধ। ক্ষতিগ্রস্ত হবে সমাজ ও দেশ।

সন্ধ্যা হতেই নগরের বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন কিংবা সুরমা নদীর তীরে দেখা মেলে সালাই ও বিলালের মত আরো অনেক পথশিশুদের। বসে বসে সেবন করছে ড্যান্ডি নামক এই নেশাদ্রব্য। জুতা কিংবা ফোমে ব্যবহৃত সলিউশন (আঠা) পলিথিনে ভরে কিছুক্ষণ পরপর মুখের সামনে নিয়ে শ্বাস টেনে নেশা করে তারা। মাদক সেবনের টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে খুনোখুনিরও ঘটনা ঘটছে। তবে এই আঠা নিষিদ্ধ কোনো বস্তু না হওয়ায় এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। তবে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা শিশুদের কাছে এটি বিক্রি না করার জন্য ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা চেয়েছেন।

সরজমিনে, শহরতলীর দক্ষিণ সুরমার রেলওয়ে স্টেশন এলাকার ডগেরপাড়, নগরের ক্বীন ব্রিজের নিচ, কাজীরবাজার সেতু, শাহজালাল সেতু, কুশীঘাট, কাষ্টঘর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, কিছু পথশিশু বসে ঝিমুচ্ছে আর পলিথিন দিয়ে কি যেন করছে। তাদের নাম জিজ্ঞাসা করতেই উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে বলে ‘আপনারা এখানে কেন আইছেন।’ তারপরও কেউ কেউ নাম বলল, আবার কেউ কেউ মুখ ফিরিয়ে নিয়ে পলিথিনে শ্বাস নিতে মগ্ন।

তাদের কেউ কেউ সরাসরি বলে, ‘ড্যান্ডি বানাইয়া খাই। এটি খাইলে মনের দুঃখ থাকে না। ক্ষুধাও লাগে না।’ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৩০ থেকে ৪০ টাকায় এক ধরনের জুতার গাম কেনে শিশুরা। নগরীর প্রায় সব এলাকার দোকানেই এসব গাম পাওয়া যায়। পলিথিনের ব্যাগে আঠাল ওই পদার্থ নিয়ে কিছুক্ষণ ঝাঁকানো হয়। তারপর পলিথিন থেকে নাক বা মুখ দিয়ে বাতাস টেনে নেয়। এই নেশা ‘ড্যান্ডি’ নামে পরিচিত।

সিলেট রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় কথা হয় দুই পথশিশুর সঙ্গে। তাদের একজন সালাই জানায়, তার মা অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে। সে সারাদিন সিটি করপোরেশনের ময়লা ফেলার এলাকায় আবর্জনা থেকে কাগজ ও প্লাস্টিক কুড়িয়ে ভাঙাড়ির দোকানে বিক্রি করে ২-৩শ’ টাকা আয় করে। এরপর বিকেলে রেলস্টেশন এলাকায় বসে ড্যান্ডি নিয়ে। যেদিন টাকা কম হয় সেদিন গাঁজা সেবন করে বলে জানায় সে। ড্যান্ডি কীভাবে সংগ্রহ করা হয় এমন প্রশ্নের জবাবে সে জানায়, আমাদের দেখলে দোকান মালিকদের কেউ কেউ নাক ছিটকায়। আবার কেউ কেউ বেশি দাম নিয়ে বিক্রি করে। আবার অনেক দোকানের কর্মচারীদের সঙ্গে তাদের রয়েছে সখ্য। তারাই বিক্রি করে। জুতা সেলাইকারীদের টাকা দিলে তারা এনে দেয়।

ক্বীন ব্রিজের নিচে কথা হয় আট বছরের শিশু বিলালের সঙ্গে। সে বলে, আমার সঙ্গে থাকে রুমন, সালাই, কাদের। তারা সবাই আঠা খায়, তাই ওদের দেখাদেখি আমিও আঠা খাই। সিলেটে পথশিশুদের নিয়ে কাজ করে ইচ্ছাপূরণ নামক একটি সংগঠন। সংগঠনের সভাপতি রেশমা জান্নাতুল রুমা প্রতিদিনের সংবাদ’কে বলেন, পথশিশুদের নিয়ে কাজ শুরুর পর থেকেই দেখেছি তারা বিভিন্ন নেশায় আসক্ত। তাদের অধিকাংশই ড্যান্ডি নেশায় আসক্ত। আমাদের একটি বিদ্যালয়ে ৪২ শিক্ষার্থী রয়েছে। তাদের ক্লাসে ধরে আনার পর দেখা যায় কারও মুখে গুল, কারও হাতে গাম লাগানো। ক্লাস চলার সময় তারা অনেকেই ঝিমুতে থাকে। নগীরর বিভিন্ন এলাকায় ড্যান্ডি নেশায় আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ৮ থেকে ১০ বছর বয়সের শিশুরা সাধারণত গাঁজা, সিগারেট ও গাম সেবন করে। ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সীরা ফেনসিডিল ও হেরোইন সেবন করে। মধ্যবিত্ত বা উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের কিশোর-তরুণদের নেশার অন্যতম উপকরণ ইয়াবা। তবে অধিকাংশ পথশিশু ড্যান্ডি নেশায় আসক্ত।

সিলেট মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মো. জাফরুল্লাহ কাজল জানান, জুতার আঠা নিষিদ্ধ কোনো বস্তু নয়। এ কারণে এ বিষয়ে কিছু করতেও পারছি না। এটি একটি নতুন নেশা। সিলেটের অনেক পথশিশু এই নেশায় জড়িয়ে পড়ছে। গাম যেহেতু আমাদের একটি প্রয়োজনীয় দ্রব্য তাই বিক্রি বন্ধ করা যাবে না। তবে আমাদের এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। এটি যারা বিক্রি করেন তারা একটু সচেতন হলেই এ নেশা থেকে শিশুদের নিরাপদ রাখা সম্ভব।

এ ব্যাপারে সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এডভোকেট এমাদ উল্লাহ শহীদুল ইসলাম শাহীন এ সকল মাদকাসক্ত শিশুদের উদ্ধারের উপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, সমাজসেবা অধিদপ্তর, পুলিশ এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তর এ সকল শিশুদের উদ্ধার করে ভাল পথে ফিরিয়ে আনতে পারে। সরকারের পাশাপাশি এনজিওগুলো এ ব্যাপারে উদ্যোগী হতে পারে।

Advertisement

আবশ্যক

প্রতিটি উপজেলায় সংবাদদাতা আবশ্যক। যোগাযোগ ০১৭১৪৪৯৭৮৮৫

এ বিষয়ে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) বিভুতি ভূষণ ব্যানার্জী বলেন, শিশু অধিকার আইনে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ খুবই কঠিন। এ বিষয়ে সর্বপ্রথম জনসচেতনতা বাড়ানো দরকার। পাশাপাশি সমাজসেবা অধিদপ্তর এ সকল মাদকাসক্ত শিশুদের উদ্ধার করে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে পারে। প্রয়োজনে পুলিশ সমাজসেবা অধিদপ্তরকে সহায়তা করবে।

তিনি আরো বলেন, এ সকল মাদকাসক্ত শিশুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা না হলে এরা বিপথগামী হয়ে পড়বে। এরা অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়লে সমাজ অন্ধকারের পথে চলে যাবে। কাজেই এদের রক্ষার্থে সমন্বিত উদ্যোগ দরকার।

ড্যান্ডি নেশার ছোবলে পথশিশুরা, জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধে!