ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম(টিভি),আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর সংবাদ সম্মেলন,মঙ্গলবার ২৭ মে ২০২৫ || জ্যৈষ্ঠ ১৩ ১৪৩২ :
ঢাকার অপরাধজগতের ত্রাস শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনকে গ্রেপ্তার করেছে সেনাবাহিনী। আজ মঙ্গলবার সকালে কুষ্টিয়া শহরের কালীশংকরপুর এলাকায় তিন ঘণ্টার এক শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানে সহযোগীসহ তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
মঙ্গলবার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। বিকেল ৫টায় এ সংক্রান্ত একটি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বিস্তারিত জানানো হবে বলেও আইএসপিআর জানায়।
Advertisement
শহরের বাসিন্দারা জানান, সেনাবাহিনীর সদস্যরা আজ ভোর ৫টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত কালীশংকরপুর এলাকার সোনার বাংলা মসজিদের পাশে স্থানীয় মীর মহিউদ্দিনের মালিকানাধীন একটি তিনতলা বাড়ি ঘিরেন রাখেন। এ সময় তারা বাড়ির নিচতলা ও আশপাশের এলাকায় দীর্ঘ সময় ধরে তল্লাশি চালায়। বাড়ির দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মেস হিসেবে থাকেন।
সেই মেসের কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, কয়েক দিন ধরে নিচতলায় এক দাড়িওয়ালা অপরিচিত ব্যক্তিকে থাকতে দেখা যাচ্ছিল। তিনি দিনে একবার শুধু খাওয়ার সময় বাইরে বের হতেন। অভিযানের সময় সেনাসদস্যরা শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট দুটি কক্ষে বসিয়ে রাখেন এবং বারবার বলেন, ‘তোমাদের কোনো ভয় নেই।’ অভিযান শেষে একজন সেনা কর্মকর্তা শিক্ষার্থীদের বলেন, এখন বললে ভয় পাবে। পরে মিডিয়ার মাধ্যমে সব জানতে পারবে।
কুষ্টিয়া জেলা পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) ফয়সাল মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, এখানে আমাদের কোনো অভিযান ছিল না। অন্য কোনো বাহিনী করেছে কি না, জানি না। জানার চেষ্টা করছি।
শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ৩০টিরও অধিক হত্যা মামলাসহ প্রায় ১০০ অবৈধ অস্ত্র এবং চাঁদাবাজি মামলার আসামি। প্রায় সবগুলো হত্যা মামলায় তিনি সাজাপ্রাপ্ত। ২০০১ সালে পুরস্কার ঘোষিত এই শীর্ষ সন্ত্রাসী আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকার রেড কর্নার নোটিশপ্রাপ্ত।
অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রায় দেড় বছর আগে বিশেষ ব্যবস্থায় ভারত থেকে তাকে বাংলাদেশে পাঠানো হয়। এর পেছনে উদ্দেশ্য ছিল টার্গেটেড রাজনৈতিক গুপ্তহত্যার জন্য ভিন্ন পরিচয়ে যুক্তরাজ্যে পাঠানো। তৈরিও করা হচ্ছিল সেভাবেই। কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট হঠাৎ তার আশ্রয়দাতারা ক্ষমতাচ্যুত হলে আত্মরক্ষার্থে পেশাদার এই অপরাধী সাধারণ জনগণের সঙ্গে মিশে যায়।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, ২০০১ থেকে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা আইবির (ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো) ছত্রচ্ছায়ায় ছিল সুব্রত। ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনী তাকে ব্যবহার করে বাংলাদেশে অবস্থান করা ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফা, নাগাল্যান্ড লিবারেশন ফ্রন্টের নেতাসহ, মোস্তাকিম চাপ কাবাবের মালিক মোস্তাকিমকে হত্যা করিয়েছে।
বিশেষ সূত্রমতে, বর্তমানে ভারতীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে কাজ করছে তিমোথি সুব্রত বাইন হিসেবে পরিচিত এই সন্ত্রাসী।
আগস্ট পরবর্তী সময়ে আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী মতিঝিলের ইখতিয়ারের (মালিবাগ সানরাইজ হোটেলে ডিবি পুলিশের সদস্য হত্যা মামলার আসামি) মাধ্যমে সুব্রত অস্ত্র ক্রয় করছে। থানা থেকে লুট হওয়া প্রায় ১৭টি অস্ত্র বর্তমানে তার হাতে রয়েছে। সুব্রত তার ডান হাত হিসেবে পরিচিত আরেক পুরস্কার ঘোষিত সন্ত্রাসী মোল্লা মাসুদের (বর্তমানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে অবস্থানরত) মাধ্যমে মতিঝিল গোপীবাগের একটি ক্রীড়া প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, সুব্রত সুইডেন আসলামের সঙ্গে দেখা করে কাওরান বাজার এলাকার নিয়ন্ত্রণ একসঙ্গে নেওয়ার ব্যাপারেও সমঝোতা করেছেন। এছাড়াও তাকে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে হাসিনার অনুগত কিছু নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তা পরোক্ষ মদদ দিচ্ছে বলে অনুসন্ধানে জানা যায়।
সুব্রত সম্প্রতি নেপালে পলাতক বিডিআর ম্যাসাকারের সহযোগী (পরে হাসিনা নিজে তার নাম চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়ার ব্যবস্থা করে) হাজারীবাগের হারুন অর রশীদ লিটন ওরফে লেদার লিটন এবং যুবলীগের ক্যাসিনো সম্রাট (বর্তমানে কলকাতায়) ও খালেদের (বর্তমানে মালেয়শিয়ায়) মাধ্যমে কম মূল্যে অস্ত্র কেনার সমঝোতা করেছে। বর্তমানে দেশের অভ্যন্তরে হাইভ্যালু টার্গেট এসাসিনেশনের পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে এই সন্ত্রাসী।
উল্লেখ্য, বিডিআর হত্যাকাণ্ডের প্রথমদিন ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সাবেক বিডিআর সদস্য তোরাব আলীর মোবাইল থেকে যে ১১টি কল ভারতে করা হয়েছিল, তার ৫টি কলই ছিল সুব্রত বাইনের কলকাতার মোবাইল নম্বরে। ঘটনা সম্পর্কে লেদার লিটন আপডেট দিচ্ছিল সুব্রত বাইনকে।
ভারতীয় দূতাবাস কর্মকর্তা শৈবাল রায় চৌধুরী ২০০১-২০০৫ এবং সমীর কুমার দিক্ষিত ২০০৫-২০১০ সালে এক সময় সুব্রত বাইনের হ্যান্ডলার ছিল বলে দাবি করেছে বিশেষ একটি সূত্র। এই সমীর কুমার দিক্ষিত বিডিআর ঘটনার পরিচালনাকারীদের অন্যতম বলেও সূত্র উল্লেখ করেছে।
এদের দুজনের সাথেই রয়েছে সুব্রত বাইনের নিয়মিত যোগাযোগ। মূলত মানিকগঞ্জ পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর এবং জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য সুভাষ চন্দ্র সরকারের মাধ্যমে সুব্রতর সঙ্গে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সংযোগ স্থাপিত হয়। সুভাষকে বাংলাদেশে ভারতীয় র-এর গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করে বিশেষ সংস্থা।
এই সুভাষ আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের এক প্রকারের গুরু। জানা যায়, সুভাষ সরকারের কারণেই ভারতীয় প্রভাবে তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে বহাল থাকেন। এছাড়াও সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের সমস্ত ভারতীয় যোগাযোগ এই সুভাষ রক্ষা করতো।
Advertisement
বিশেষ করে আজিজের ভাই শীর্ষ সন্ত্রাসী হারিছ আহমেদের ভারতে অবস্থান ও সুবিধাদি সুভাষের মাধ্যমে রক্ষা করা হতো। কলকাতায় সুব্রত, হারিছ, মোল্লা মাসুদ, হান্নানসহ (লিয়াকতের ছোট ভাই) অনেকের স্থানীয় অভিভাবক ছিলেন গৌর গোপাল সাহা, যিনি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এই ভারতীয় বলয় বহু ডালপালার অধিকারী।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, সুভাষ সরকার গত বছরের ডিসেম্বরে গ্রেপ্তারের আগে সুব্রত বাইনের সঙ্গে যোগাযোগ করে শীর্ষ সন্ত্রাসী জোসেফ ও হারিছের মোহাম্মদপুরের সাম্রাজ্য বাইনের কাছে দিতে চেয়েছিলেন, যাতে সেখানে ইমন বা পিচ্চি হেলাল আধিপত্য বিস্তার করতে না পারে। কিন্তু ওই ফোন মিটিংয়ের আগেই সুভাষ সরকারকে গ্রেপ্তার করা হয়।